শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অর্থনীতি

করোনায় বান্দরবানের পর্যটনশিল্পে শতকোটি টাকার ক্ষতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৭ জুন ২০২০

করোনাভাইরাসের ছোবলে ধস নেমেছে সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প খাতেও। লকডাউন পরিস্থিতিতে অকেজো হয়ে পড়েছে পর্যটননির্ভরশীল পাহাড়ের অর্থনীতির চাকাও। থমকে গেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানের পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত আবাসিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউস, রেস্টুরেন্ট, হস্তশিল্প, পরিবহন এবং স্থানীয়দের ঐতিহ্যগত বৈচিত্র্যময় পোশাক-কাপড়ের ব্যবসা-বাণিজ্যও। প্রায় তিন শতাধিক ট্যুরিস্ট গাড়ির শ্রমিকরাও বেকার হয়ে পড়েছেন।

জানা গেছে, বান্দরবান জেলাটি পুরোটাই পর্যটননির্ভর। স্থানীয়ভাবে একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পর্যটনের মৌসুমে বা ভরা মৌসুমে শুধু বান্দরবান সদরের আবাসিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউসগুলোর দৈনিক ক্ষতি ৫০ লাখেরও বেশি। মাসিক সেই ক্ষতির অঙ্কটা দাঁড়ায় প্রায় ১৫ কোটি টাকার। আর রেস্টুুরেন্টগুলোর মাসিক ক্ষতি সাড়ে ২৩ লাখ টাকারও বেশি। এছাড়া পরিবহন, ঐতিহ্যগত পোশাক-হস্তশিল্পের দোকানসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য ও ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর টিকিট বিক্রির আয়ের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ প্রায় চার মাস ধরে পর্যটকের আনাগোনা নেই। পর্যটকশূন্য সম্ভাবনায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি-খ্যাত বান্দরবান জেলা যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। চারদিকে শুধুই হাহাকার। তালা ঝুলছে দর্শনীয় স্থান মেঘলা, নীলাচল, চিম্বুক, নীলগিরি, প্রান্তিক লেক, স্বর্ণমন্দির ও ন্যাচারাল পার্কের মতো আকর্ষণীয় স্পটগুলোয়। প্রাণহীন জনমানবহীন ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়েছে পাহাড়ের চূড়ায় রুমায় অবস্থিত রহস্যময় প্রাকৃতিক বগা লেক, দেশের পর্বতশৃঙ্গ ক্যাংক্রাডং, বিজয় পাহাড় চূড়া, রিজুক ঝরনা, তিনাফ সাইতার ঝরনা, জাদীপাই ঝরনা, থানচির নীলদিগন্ত, রেমাক্রী, নাফাকুম ঝরনা, অমিয়কুম ঝরনা, বাদুড়গুহা, বড়পাথর, দেবতা পাহাড়, আলীকদমের দামতোয়া ঝরনা, পোয়ামুহুরী ঝরনা, আলীর সুড়ঙ্গপথ, রোয়াংছড়ির দেবতাকুম, শীলবাঁধা ঝরনা, শিপ্পি পাহাড় চূড়া, রামজাদী বৌদ্ধ মন্দির, লামার মিরিঞ্জা পর্যটন স্পট, নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন পর্যটন স্পট, কুমির খামার, সদরের শৈলপ্রপাত ঝরনা, আমতলী ঝরনা, ঝুরঝুরি ঝরনা বা রুপালি ঝরনা ও বনপ্রপাতের দৃষ্টিনন্দন দর্শনীয় স্থানগুলো।

অথচ মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে সারা বছরই ভ্রমণপিপাসু দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণে মুখরিত থাকত দর্শনীয় স্থানগুলো। মেঘলা, নীলাচল, চিম্বুক, নীলগিরি ও স্বর্ণমন্দিরের অন্যতম পর্যটন স্পটগুলোয় তিল ধারণের জায়গা থাকত না মানুষের ভিড়ে। এখন পর্যটন স্পটগুলোয় তালা ঝুলছে। মনোমুগ্ধকর অবকাঠামো, শিল্পকর্ম ও সড়কজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ঝরে পড়া গাছের পাতা। দর্শনার্থীদের ভিড় না থাকায় শ্যাওলা পড়ে গেছে পর্যটন স্পটগুলোর কোথাও কোথাও। ঘাস জেগেছে হাঁটার রাস্তায়। 

বান্দরবান রেসিডেন্সিয়াল অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারা বছরই পর্যটকের ভিড় থাকে বান্দরবান। কিন্তু ঈদের ছুটি ও লম্বা বন্ধের সময়টাতে চাপটা কয়েকগুণ বেড়ে যেত। তবে করোনা মহামারির লকডাউনে ধস নেমেছে পর্যটনশিল্পে। ক্ষতির হিসাবটা নির্ণয় করা কঠিন হবে। তবে শুধু সদরে ৫৮টি আবাসিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও গেস্টহাউস রয়েছে। তালিকার বাইরেও আছে আরও কয়েকটি।

সমিতির একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চার মাসের লকডাউনে ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে শুধু আবাসিক হোটেল মালিকদের। জেলার বাকি ছয়টি উপজেলায় তিনটি করে আরও ১৮টি আবাসিক হোটেল ধরা হলেও ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেড়ে যাবে, যা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সরকার যদি মালিকদের প্রণোদনার আওতায় এনে সুদমুক্ত কোনো ঋণের ব্যবস্থা না করে, তাহলে কষ্টের সীমা থাকবে না।

রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল আলম জানান, সদরে সমিতির তালিকাভুক্ত ৪৭টি ছোট-বড় রেস্টুরেন্ট রয়েছে। গড়ে রেস্টুরেন্টগুলোর মাসিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রায় চার মাস ধরে সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ রয়েছে। সে হিসাবমতে, প্রায় ৯৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

পাহাড়িদের ঐতিহ্যগত পোশাক-হস্তশিল্প ব্যবসায়ী এসানু মারমা জানান, পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে এই অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোও। নীংলা তং নামে ট্যুরিস্ট স্পট নীলাচলে আমারও একটি দোকান রয়েছে। কিন্তু চারটি মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ। দোকান না খোলায় পাহাড়ি গ্রামের মানুষদের কাছ থেকেও বিভিন্ন ধরনের পণ্য সংগ্রহ বন্ধ রেখেছি। ফলে সামগ্রিকভাবে সবাই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। শুধু ট্যুরিস্টনির্ভর এ ধরনের দোকানের সংখ্যাও শতাধিক বলে তিনি জানান।

ট্যুরিস্ট পরিবহন জীপ-মাইক্রো শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কামাল জানান, সদরে প্রায় তিন শতাধিক ট্যুরিস্ট গাড়ি রয়েছে। শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় চার শতাধিক। কিন্ত চার মাস ধরে গাড়িগুলো চলাচল বন্ধ করে পড়ে রয়েছে। সবাই অর্থনৈতিক সংকটে মানবেতন জীবন কাটাচ্ছে। পর্যটক না থাকায় ফাঁকা লাগছে বান্দরবান শহরটি।

এ বিষয়ে বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. শামীম হোসেন বলেন, মহামারি করোনার ছোবলে সবকিছুই যেন লণ্ডভণ্ড। অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটনসংশ্লিষ্ট সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। পর্যটকশূন্য বান্দরবান জেলাটি চিরচেনা রূপে কখন ফিরবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে লকডাউনে ট্যুরিস্ট স্পটগুলো বন্ধ থাকায় এখানে প্রকৃতি যেন ফিরেছে স্বরূপেই। একদিকে অর্থনৈতিক ক্ষতি, অন্যদিকে প্রকৃতিতে এসেছে সমৃদ্ধি বলেও মনে করেন তিনি।

ভ্রমণে করোনা আক্রান্ত হলে ৩ হাজার ডলার করে পাবেন পর্যটকরা!
মিসর ভ্রমণে ভিসা ফি দিতে হবে না পর্যটকদের

আপনার মতামত লিখুন