বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয়

বিনিয়োগ টানছে পর্যটন

 শেখ আবদুল্লাহ
০৪ মার্চ ২০২০
সেন্টমার্টিন দ্বীপ    -ফাইল ছবি

সেন্টমার্টিন দ্বীপ -ফাইল ছবি

ঘুরে বেড়ানোর পুরোনো ছবি ফেসবুক নিউজ ফিডের মেমরিতে এলে একটু হলেও উসখুস করে মন। বন্ধুদের পোস্ট করা ছবি দেখেও এমনটা মাঝে মধ্যেই হয়, নয় কি? আবার কবে ঘুরতে যাব মনের ঈষান কোণে ভেসে বেড়াতে থাকে এমন ভাবনা। নতুন ভ্রমণ পরিকল্পনা ডালপালা মেলতে থাকে। এক সময় তা বাস্তবেও রূপ নেয়। এভাবেই কখনও পরিবারের সঙ্গে, কখনও বন্ধুদের নিয়ে দূরে কোথাও অবসর যাপনে বেরিয়ে পড়ার হারও বাড়ছে। শুধু শীতের আমেজের মধ্যে নয়, এখন একটু ছুটির ফুরসত মিললেই প্রিয় গন্তব্যের পথে নেমে পড়েন সবাই।
নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রায় সবার মধ্যেই ঘুরে বেড়ানোর শখ কম-বেশি মজ্জাগত। এর সঙ্গে দেশের গত এক দশকের আর্থসামাজিক উন্নতিও উৎসাহ দিচ্ছে ভ্রমণের। গড় মাথাপিছু আয় বেড়ে বর্তমানে এক হাজার ৯০০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যার বড় অংশই তরুণ, যাদের বড় অংশই ভ্রমণপিপাসু।
অন্যদিকে দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগাযোগ বেড়েছে। এতে আগের চেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটকও বাংলাদেশে আসছেন ভ্রমণে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে পর্যটন চাহিদা বেড়েছে। এমন চাহিদা বিবেচনায় দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা পর্যটনের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছেন।
তারকা হোটেল, রিসোর্ট ও মোটেল নির্মাণে যেমন বিনিয়োগ হচ্ছে, তেমনি পর্যটন কেন্দ্রের অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবহন, খাওয়া-দাওয়া, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ট্রাভেল এজেন্সি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। ব্যক্তি উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে যেমন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠছে, তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে রিসোর্ট।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশি-বিদেশি ৭০ থেকে ৭৫ লাখ ব্যক্তি বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করছেন। কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা ও সিলেটেই পর্যটক যাচ্ছে বেশি। অন্যান্য জেলায় দর্শনীয় স্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনা থাকলেও সুযোগ-সুবিধা ও প্রচারের অভাবে সেখানে পর্যটক যাচ্ছেন কম।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল বাংলাদেশের পর্যটন খাতের ওপর জরিপ করে বলেছে, দেশের জিডিপির ৪ দশমিক ৪ শতাংশ আসছে এ খাত থেকে। গত বছর পর্যটন খাতে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৯ সাল শেষে পর্যটন খাতে বাংলাদেশে ৩১ লাখ ৫৫ হাজার জনের কর্মসংস্থান হবে বলে সংস্থাটি মনে করে।
পর্যটন খাতের এ আন্তর্জাতিক সংস্থা মনে করে, বাংলাদেশে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৮ সালে এ খাতে ৮ শতাংশ বেড়ে বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৯৬৪ কোটি। চলতি বছরেও বিনিয়োগ বাড়ছে।
পর্যটন ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, পর্যটন খাতের সম্প্রসারণ হচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এলেও তা আশানুরূপ নয়। তবে পর্যটকদের কিছু মূল চাহিদা রয়েছে, যেখানে নানা সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে যাতায়াত সহজ করা, পর্যটকদের নিরিবিলি সময় কাটানোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদিতে এখনও ঘাটতি রয়েছে।
বিদেশি পর্যটক আগমনও সম্প্রতি বেড়েছে। ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে পর্যটন ভিসায় বাংলাদেশে এক লাখ ৪১ হাজার ৯১৭ বিদেশি এসেছিলেন। ২০১৮ সালে ভ্রমণ করেছেন দুই লাখ ৬৭ হাজার ৭০৭ জন। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এসেছেন এক লাখ ৮৯ হাজার ৮৮৭ জন। ব্যবসায়িক কারণেও বর্তমানে বিদেশিদের আসা-যাওয়া বেড়েছে। বড় প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল, আইটি খাতের সম্প্রসারণ হচ্ছে। দেশের পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই বিদেশিরা আসছেন। আসছেন খেলাধুলাকে কেন্দ্র করেও। ফলে বিদেশিদের ভ্রমণ বেড়েছে।
হোটেলে বিনিয়োগ
দেশে বর্তমানে ১৭টি পাঁচ তারকা, চারটি চার তারকা এবং ১৯টি তিন তারকা মানের হোটেল রয়েছে। এর বড় অংশ রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। বাকিগুলো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, বগুড়া, গাজীপুর, খুলনা, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, বরিশাল ও যশোরে অবস্থিত। এর বাইরে আরও কিছু পাঁচ ও তিন তারকা হোটেল নির্মাণাধীন।
বেঙ্গল গ্রুপ রাজধানীর নিকেতনে একটি পাঁচ তারকা মানের হোটেল তৈরি করছে। ৩৭০ রুমের এ হোটেল নির্মাণে বিনিয়োগ হবে ৬০০ কোটি টাকা। সুইডিশ হোটেল চেইন সুইস হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট এটির ব্যবস্থাপনায় থাকবে। হোটেলটি এখনও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি পায়নি। উত্তরায় এ গ্রুপের আরেকটি হোটেল বেঙ্গল হাইটস মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি পেয়েছে। হলিডে ইন নামের ২০০ রুমের একটি হোটেল নির্মাণ প্রায় শেষ হয়েছে। হোটেলটি নির্মাণে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
মৌলভীবাজারে প্যারাগন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, কক্সবাজারে উইন্ডি টেরেজ বুটিক হোটেল, বগুড়ায় হোটেল সিয়েস্টা, সিলেটে গ্র্যান্ড প্যালেস, হবিগঞ্জের বাহুবলে দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট, রাজধানীর উত্তরায় ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট নামের হোটেলের নির্মাণ কাজ চলছে। এসব হোটেল ইতোমধ্যে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেয়ে লাইসেন্সের অপেক্ষায় রয়েছে।
এ ছাড়া ছাড়পত্র পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে গাজীপুরে জাভান হোটেল, মৌলভীবাজারে দুসাই হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, কক্সবাজারে গ্রিন ন্যাচার, গাজীপুরে সারাহ রিসোর্ট ও রাজধানীতে ইউনিক শেরাটন।
অন্যান্য বিনিয়োগ
হোটেলের বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠান পর্যটকদের কথা চিন্তা করে বিলাসবহুল পরিবহন সেবা নিয়ে আসছেন। কয়েকটি কোম্পানি নৌ-ভ্রমণের কথা চিন্তা করে বিলাসবহুল লঞ্চ সেবা চালু করেছে। নতুন ট্রাভেল এজেন্সি চালু হচ্ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম বিভাগ চালু করেছে। প্রশিক্ষণের আলাদা ব্যবস্থাও হয়েছে।
ব্যাংকের বিনিয়োগ
পর্যটন খাতের প্রসার হওয়ায় ব্যাংকগুলোও অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে। কয়েকটি ব্যাংকের পর্যটন কেন্দ্রিক ঋণও রয়েছে। এ ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকের কার্ডে পর্যটন খাতের নানা সুযোগ-সুবিধা সংযুক্ত। বিশেষ করে ক্রেডিট কার্ডে হোটেল বুকিং ও বিমানে টিকিট বুকিং দিলে ছাড় রয়েছে। তারকা হোটেলের খাওয়া-দাওয়ার বিলেও ছাড় দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সরকারের বিনিয়োগ
পর্যটন সুবিধা বাড়াতে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে নতুন করে কয়েকটি বিমানবন্দর স্থাপন এবং কয়েকটির সম্প্রসারণ অন্যতম। কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বাগেরহাটে খানজাহান আলী বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য কাজ করছে সরকার। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ ট্যুরিজম পার্ক, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ও সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক করছে সরকার। সংশ্নিষ্টরা আশা করছেন, এসব পার্ক পর্যটন খাতে নতুনত্ব আনবে।
সীমাবদ্ধতা
বিশেষ ট্যুরিজম আইন বাস্তবায়ন না হওয়া, ঢাকা শহরের যানজট, ঢাকা থেকে বাইরে যেতে সড়কে যানজট, পর্যটনের উপযুক্ত অথবা আলাদা পরিবহন ব্যবস্থার অভাব, শ্রান্তি বিনোদনের বিশেষ কেন্দ্রের অভাব, পেশাদার জনবলের ঘাটতি, বিদেশে ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব এ খাতের অন্যতম সীমাবদ্ধতা। এ ছাড়া দেশে পর্যটনের খরচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বেশি।
আরও দরকার
পর্যটন খাতে আরও বিনিয়োগ দরকার। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে সহজে পৌঁছতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পার্বত্য জেলাগুলো ও কক্সবাজারে যাতায়াতে দু'দিনের বেশি চলে যায়। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও উন্নত করতে হবে।

ঘুরে আসুন ঋণ নিয়ে
ভ্রমণের জন্য বিনা সুদে ঋণ

আপনার মতামত লিখুন