বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয়

কী দোষ দুধের শিশুটির, কেন এমন নিষ্ঠুরতা?

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৩ জুলাই ২০২০

‘করোনা সন্দেহে ওরা আমার মেয়েকে ধরেনি। তারা চিকিৎসা দেয়নি। ৩০টি হাসপাতাল ঘুরেছি, সবাই তাড়িয়ে দিয়েছে। একটি হাসপাতাল ভর্তি নিলেও চিকিৎসার অভাবে মারা গেল মেয়েটি। মনকে বোঝাতে পারছি না কোনোভাবে। এভাবে কারও জীবন যেন না যায়। কারও মায়ের বুক যেন আর খালি না হয়।’

সাদা কাপড়ে মোড়া মেয়েকে কোলে আঁকড়ে কান্নায় ভেঙে পড়া বাবা নাছির উদ্দিন এসব কথা বলেন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে দুধের শিশু নাদিয়া ইসলামকে নিয়ে বাবা-মা আসেন ঢাকা শহরে। কিন্তু করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া কেউ ভর্তি নিচ্ছিল না। ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ বহু হাসপাতাল ঘুরেছেন। শহরের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ছুটেছেন। কেউ শোনেনি তাদের আকুতি। চিকিৎসা না পাওয়ায় বাঁচতে পারল না শিশুটি। গত ২৫ জুন রাজধানীর পান্থপথের ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে মারা যায় এক বছরের শিশু নাদিয়া। গত ২৩ জুন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর ইউনিয়নের চর রশিদ গ্রামের বাসিন্দা নাছির উদ্দিন তার মেয়েকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করান। 

নাছির উদ্দিন বললেন, ‘করোনার ভয়ে কেউ চিকিৎসা দিল না, আমার বাচ্চাটা মরে গেল। এতগুলো হাসপাতালে গেলাম, কোথাও কিছু হল না। ওর কী দোষ, বলতে পারেন।’

তিনি বলেন, মেয়ের পাতলা পায়খানা-বমির পর বুকেও সমস্যা দেখা দিলে ২২ জুন রাত ১টায় নিয়ে যাওয়া হয় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে। সকাল ১০টায় চিকিৎসকরা মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বললেন। তারপর ঢাকা শিশু হসপিটালে নিয়ে আসি। কিন্তু মেয়কে আইসিইইউতে রাখার কথা জানিয়ে অন্য হাসপাতালে নিতে বলেন। এ ছাড়া করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট না থাকলে ভর্তি নেওয়া হবে না বলে হাসপাতালের গেইট থেকেই আমাকে নিরাপত্তাকর্মীরা তাড়িয়ে দেন।  মেয়ের কষ্ট এবং আমার কান্নাও কাউকে স্পর্শ করেনি। শিশু হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতালে যোগাযোগ করলাম, কিন্তু কোথাও ভর্তি করাতে পারিনি। মেয়েটাকে নিয়ে যখন আমি দিশহারা, কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছি না তখন একজন খোঁজ দিলেন পান্থপথের ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালের। তারা আমার মেয়েকে আইসিউতে নিয়ে যায়, আমাদের প্রবেশ করতে দেয়নি। পরদিন ভেতরে গিয়ে দেখলাম মেয়ের অবস্থা খারাপ, কোনো আইসিউ সাপোর্ট নেই। তার হাত-পা বাঁধা, মুখে মাস্ক লাগানো। করোনার ভয়ে কেউ মেয়েটির কাছেও আসেনি। এরপর মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য ৩০টি হাসাতপালে গিয়েছি, কিন্তু কেউ করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া মেয়েকে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে একজনকে দিয়ে মেয়ের নমুনা সংগ্রহ করে একটি প্রাইভেট হাসাপাতালে পরীক্ষার জন্য দেই। অনেক অনুরোধর করেও এক দিনের মধ্যে রিপোর্ট নিতে পারলাম না। গত ২৮ জুন ওই হসপিটাল থেকে জানানো হলো আমার মেয়ের করোনা নেগেটিভ। কিন্তু ২৫ জুন দুধের শিশুটি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে।’

গ্রামে গিয়ে মেয়ের লাশ দাফনের পর নাসির উদ্দিন ফেসবুক লাইভে তুলে ধরেন তার আকুতি। কান্না করতে করতে তিনি বলেন, ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতাল দুই দিনে ৪০ হাজার টাকা বিল ধরিয়ে দিয়েছে। সেই টাকা পরিশোধ করে মেয়ের লাশ নিয়ে গ্রামে চলে এসেছি।

তিনি বলেন, ঢাকা শহরে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা না পেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। সরকারের এ দিকে নজর দেওয়া উচিত। যারা আইসিইউ’র নামে কসাইখানা খুলেছে তাদের বিচার হওয়া উচিত।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল হাকিম সমকালকে বলেন, ‘আমাদের আইসিইউ সাপোর্ট আছে। কিন্তু সব সময় খালি থাকে না। তবে এমনিতে সাধারণ কোনো শিশু রোগী এখানে এসে ভর্তি হতে পারেনি, এমন কোনো রেকর্ড নেই। করোনার সময়ে ঢাকা শিশু হাসপাতাল সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখানকার কর্মীরা অনেকেই ডাবল ডিউটি করছেন। হাসাপতালে ভর্তির ক্ষেত্র কখনই করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট চাওয়া হয় না।’

ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ম্যানেজার মনির হোসেন বলেন, ‘অনেকগুলো হসপিটাল ঘুরে রোগী আমাদের এখানে এসেছে। শিশুটির অবস্থা খুবই মুমূর্ষ ছিল, একেবারে নিস্তেজ ছিল। তাকে আইসিইউতে রাখার মতোও অবস্থা ছিল না। তারপরও রোগীর স্বজনদের অনুরোধে ভর্তি নিয়েছি, সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েছি। আমরা তাদের বার বার বলেছি অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে।’

দেশে-বিদেশে মানবতার ফেরিওয়ালা 'সুবর্ণ প্রবাসী ফাউন্ডেশন'
এখন এরা মুক্ত বিহঙ্গ

আপনার মতামত লিখুন