বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঘুরে আসি

স্কুটিতে দুই নারীর ৬৪ জেলা ভ্রমণ

যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ
২৫ জুন ২০১৯
স্কুটি নিয়ে ৬৪ জেলায় সফরকারী ডা. সাকিয়া হক ও ডা. মানসী সাহা। আলোকচিত্রী: সজীব চন্দ

স্কুটি নিয়ে ৬৪ জেলায় সফরকারী ডা. সাকিয়া হক ও ডা. মানসী সাহা। আলোকচিত্রী: সজীব চন্দ

২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল খুলনার মেয়ে ডা. সাকিয়া হক ও নড়াইলের মেয়ে ডা. মানসী সাহার নেতৃত্বে ৬৪ জেলা ভ্রমণের যাত্রা শুরু হয়। প্রায় দুই বছর সময় নিয়ে চলতি বছরের ৫ মে তারা ৬৪ জেলা ভ্রমণ শেষ করেন।

ডা. সাকিয়া হক ও ডা. মানসী হক দুজনেরই বেড়ে ওঠা খুলনায়। একই স্কুল থেকে এসএসসি, কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমবিবিএসে ভর্তি হন দুজনে। ডা. সাকিয়া হকের বাবা সামছুল হক ছিলেন পেশায় একজন ব্যাংকার। মা আক্তার শাহনাজ হক একজন গৃহিণী। বাবা মারা যাওয়ার পর মা-ই হয়ে ওঠে তার একমাত্র নির্ভরতা। ভ্রমণের পরিকল্পনা সম্পর্কে ডা. সাকিয়া হক বলেন, আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম, স্কুটিতে চড়ে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করব।

ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আবার ঢাকা ফিরে আসি। এভাবে আমরা বিভিন্ন ধাপে যাত্রা করি। ভ্রমণের পাশাপাশি নারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, বাংলাদেশের মেয়েরা চাইলে ভ্রমণ করতে পারে, কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত তথ্য, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরতে চেয়েছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস নারীরা যদি মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা না করতেন, আশ্রয় না দিতেন, আহতদের সেবা না করতেন তাহলে আমরা দেশের স্বাধীনতা পেতাম না।

৬৪ জেলা ভ্রমণে পরিবারের সম্মতি কতটুকু ছিল এ সম্পর্কে ডা. মানসী সাহা বলেন, আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা তরুণ কুমার সাহা আর মা লক্ষ্মী রানী সাহা’র বিষয়টি মেনে নেয়া একটু কঠিন ছিল। একজন মেয়ে স্কুটিতে চড়ে দেশের ৬৪টি জেলা ভ্রমণ করবে, তার নিরাপত্তার দিকটির কথা চিন্তা করে ব্যবসায়ী বাবার প্রথমে রাজি না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রথম আপত্তি জানিয়েছেন আমার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মর্কতা মা।

তিনি বললেন, ‘এভাবে ভ্রমণ কখনোই নিরাপদ না। স্কুটি যেখান থেকে নিয়ে এসেছ সেখানে ফেরত দিয়ে এসো।’ এরপর মাকে ধীরে ধীরে বোঝালাম। আমরা শুধু ভ্রমণই করব না, নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করব। রাস্তায় দেখে শুনে চলাচল করব। এছাড়া স্কুটিতে একটা ডিভাইস লাগানো থাকবে। যাতে আমাদের সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।

মা বুঝলেন, মায়ের সম্মতি মিলল। আমাদের একটা দুটো ধাপ সম্পন্ন হতেই মা অনেক উৎসাহিত হলেন। আমাকেও উৎসাহ দিলেন। একইভাবে সাকিয়ার মাকেও বোঝাতে সক্ষম হলাম। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা আর উৎসাহে আমরা ৬৪ জেলা ভ্রমণে বের হলাম। সবসময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছি। যাতে তারা আমাদের নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা না করেন।

নারীরা স্কুটি চালিয়ে সারাদেশ ভ্রমণ করছেন। যেখানেই গেছেন অনেকে অবাক হয়েছেন এটা ভেবে মেয়েরাও স্কুটি চালায়! এ প্রসঙ্গে ডা. সাকিয়া হক বলেন, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানুষর আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করেছেন। চলার পথে দু-একটা কটূক্তি শুনিনি এমনও নয়।

তবে তাদের ওপর অভিমান না করে যখন আমরা আমাদের উদ্দেশ্যের কথা বলেছি সবাই অবাক হয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উটকো মন্তব্যও শুনতে হয়েছে আমাদের।

ডা. মানসী সাহার মতে, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মেয়েরা যাতে তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারে। নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারে। মেয়েদের ভ্রমণকে উৎসাহিত করতেই এই পদক্ষেপ নেয়া।

একই সঙ্গে আমরা চেয়েছিলাম কিশোরীদের মধ্যে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে। আমরা দুজনই ডাক্তার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেছি। ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে আমরা মেয়েদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক ধারণা দিতে বিভিন্ন স্কুলে গিয়েছি।

তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, মেয়েরা মাসিক নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পায়। অনেকের আবার মাসিক সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। মাসিক কোনো ভূত-জিনের আছর না বা লজ্জা পাওয়ার বিষয় নয়।

মাসিককালীন সময় তারা যাতে নোংরা কাপড়, পানি ব্যবহার না করে স্যানিটারি প্যাড অথবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার করে। এ ব্যাপারে তাদের প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়েছে। নারীর স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে ছোটখাটো বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

অনেক জায়গায় আমরা মেয়েদের আত্মরক্ষা বিষয়ে কর্মশালা করাই। আমাদের সমাজে সাম্প্রতিক সময়ে ইভটিজিং বা ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো বাড়ছে। তাই আমরা আকস্মিক বিপদে আত্মরক্ষার জন্য তাদের প্রাথমিক কিছু কৌশল শিখিয়েছি।

কোনো জায়গায় বাল্যবিয়ে বেশি হলে, আমরা তাদের বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতাম। রোড সেফটি নিয়ে কথা বলতাম। আর বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধ তো থাকতই।

‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ সম্পর্কে ডা. সাকিয়া হক বলেন, ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ মূলত ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যা’ নামের নারীদের নিয়ে গঠিত একটি ফেসবুক গ্রুপের অধীনে এ উদ্যোগ। ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর শুরু হওয়া এই পেজের সদস্যদের উদ্দেশ্য ছিল ভ্রমণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করা। আমরা মনে করি, ভ্রমণের মাধ্যমে যদি মেয়েরা দেশ দেখার সুযোগ পায়, তারা ঘরের বাইরে আসে, তাহলেই সে দেখতে পারবে পৃথিবীটা কত সুন্দর। ফলে মেয়েদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস জন্মাবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ডা. মানসী সাহা বলেন, সারা দেশে ৩০ হাজার মেয়ের সংগঠন ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যা। নারীর চোখে বাংলাদেশ নামের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আমরা ৬৪ জেলায় প্রতিটিতে অন্তত একটি স্কুলে হলেও বিভিন্ন বার্তা দিতে পেরেছি। সামনে আমরা পুরো বাংলাদেশের শতাধিক স্কুলে নারীর স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়গুলো ছড়িয়ে দিতে পারব।

‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ শিরোনামে স্কুটিতে চড়ে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করলেন বাংলাদেশের চার তরুণী। ভ্রমণের পাশাপাশি তারা বিভিন্ন স্কুলে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, আত্মরক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতা বিষয়ে কিশোরী-তরুণীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়েছেন। দুটি স্কুটিতে চার তরুণীর এই ভ্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডা. সাকিয়া হক ও ডা. মানসী সাহা। দুজনই পেশায় চিকিৎসক।

নারীদের কাছে ডা. সাকিয়া হক এমন বার্তা পৌঁছে দিতে চান, যারা আপনাকে খারাপ কথা বলবে বা আপনার ভালো উদ্যোগকে খারাপ ভাবে নেবে তাদের কথা শুনবেন না। যখন দেখবেন আপনি সফল হচ্ছেন, তখন আপনার পেছনের হাজার হাজার মানুষ।

ভালো কাজ কিন্তু নারীরা চাইলেই করতে পারেন। শুধু আপনার একটা ভালো পদক্ষেপের অপেক্ষা। নারী সচেতনতা ও স্বাধীনতার জন্য নারীরা যদি এগিয়ে না আসেন তাহলে কিছুই হবে না। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতেই হবে। সেই সঙ্গে পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ পুরুষদের সহযোগিতা ছাড়া নারীর স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়।

প্রত্যেক পুরুষ একজন নারীকে বোন, বন্ধু, মা ভেবে পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, নারী-পুরুষ মিলেই একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

ছুটিতে বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে
আরব আমিরাতে পর্যটকদের জন্য সিম ফ্রি

আপনার মতামত লিখুন