বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঘুরে আসি

হিমালয় কন্যা রূপসী পঞ্চগড়

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৩ অক্টোবর ২০১৯

আসছে ভ্রমণের মৌসুম। বছরের এ সময়ে সৌন্দর্যপিপাসুরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। দেশের অগ্রসরমান পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে পদে পদে নানা ভোগান্তির শিকার হন তারা। স্পটগুলোর নানা প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরতে আমাদের এ আয়োজন।

ঢাকা থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। হিমালয়ের পাদদেশে জেলাটির ভৌগোলিক অবস্থান হওয়ায় পঞ্চগড়কে বলা হয় হিমালয় কন্যা।

খালি চোখে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা অবলোকন, পাহাড়ি ঢল থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলধারার নদী, সমতল ভূমির চা-বাগান, বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল আর প্রাগৌতিহাসিক নানা স্থাপনা আর দুর্গ পঞ্চগড়কে গড়ে তুলতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী হিসেবে।

পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার, এভারেস্ট শৃঙ্গ ৭৫ কিলোমিটার, ভুটান ৬৪ কিলোমিটার, চীন ২০০ কিলোমিটার, ভারতের দার্জিলিং ৫৮ কিলোমিটার ও শিলিগুড়ি ৮ কিলোমিটার এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। ফলে ভৌগোলিকভাবেই পঞ্চগড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার।

খালি চোখেই কাঞ্চনজঙ্ঘা : কয়েক বছর থেকে তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে খালি চোখেই দেখা মিলছে হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘার। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের পুরোটা সময় শীতের মেঘমুক্ত নীলাকাশে ভেসে ওঠে তুষারশুভ্র হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরের উপকণ্ঠে মহানন্দার তীর ঘেঁষা সরকারি ডাকবাংলা চত্বর কিংবা জিরো পয়েন্ট থেকে দেখা মেলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতমালা হিমালয়ের।

পাশাপাশি দার্জিলিংয়ের সবুজে ঘেরা পাহাড় শ্রেণিও দেখা যায় স্পষ্ট। এছাড়াও পঞ্চগড়ের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম তেঁতুলিয়া জিরো পয়েন্ট, বারো আউলিয়ার মাজার, শাহী মসজিদ, সমতল ভূমির আরগনিক চায়ের বাগান, কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট, আনন্দ ধারা, ভিতরগড় ও মহারাজের দীঘি, বোদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির, গোলক ধাম মন্দির, বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, পাহাড়ি স্বচ্ছ জলের মহানন্দা নদী, পাথর সমৃদ্ধ রকস মিউজিয়াম, তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো, চতুর্থ চীন বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু, খয়ার বাগানসহ বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ময়নামতিরচর।

সমতলভূমির চা-বাগান : চা বাগানের কথা মনে হলেই নিশ্চয়ই ভেসে ওঠে সিলেট বা শ্রীমঙ্গলের কথা। উঁচু নিচু সবুজে ঘেরা টিলা-পাহাড় তার গায়ে সারি সারি চা গাছ। কিন্তু সমতল ভূমিতেও যে চা বাগান হতে পারে তা পঞ্চগড় না এলে বোঝা যাবে না। দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে গড়ে উঠেছে এমন অর্গানিক চায়ের প্রাণজুড়ানো সবুজ বাগান। পঞ্চগড় ইতিমধ্যে দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

প্রাক-ঐতিহাসিক নিদর্শন : শতশত বছরের পুরনো অনেক নিদর্শন রয়েছে পঞ্চগড় জেলায়। পঞ্চগড় সদর উপজেলার ভিতরগড়ে পাবেন মহারাজার দীঘি। এখানেই আছে বন বিভাগের বিশাল শালবন, আছে শালমারা বিল।

জেলার আটোয়ারী উপজেলায় আছে দেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মির্জাপুর শাহী মসজিদ (১৬৫৬)। জেলার সদরের সন্নিকটেই রয়েছে ২৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল ভিতরগর। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন, দুর্গটি নির্মাণ করেছেন পৃথু রাজ।

পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নে রয়েছে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতদের তালিকাভুক্ত সংরক্ষিত প্রত্নতত্ত্ব বোদেশ্বরী মন্দির। হিন্দু ধর্মের ১৮টি পুরাণের মধ্যে স্কন্দ পুরাণ একটি। দেবী দুর্গার (পার্বতী/মহামায়া) শবদেহের ৫১টি খণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশে পড়ে দুটি খণ্ড। একটি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এবং অপরটি পঞ্চগড়ের বোদেশ্বরীতে।

জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার অপরূপ ছায়াঘেরা আর মন ছুঁয়ে যায় এমন একটি স্থান হল ময়নামতিরচর। করতোয়া নদীর কোলঘেঁষে প্রায় ৩৫ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত এ বনাঞ্চল। যারা নৌকাভ্রমণ করতে চান তাদের জন্যও রোমাঞ্চকর হতে পারে করতোয়ার বুকে ডিঙ্গি নৌকা ভ্রমণ। সন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম রূপকার ও খ্যাতিমান নেত্রী দেবী চৌধুরানীর নামানুসারে দেবীগঞ্জ উপজেলায় আরও রয়েছে বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা খয়ের বাগান।

পঞ্চগড় জেলা সমিতির সদস্য সচিব কৃষিবীদ আবদুর রহমান বলেন, পঞ্চগড়ের মানুষ বেশ শান্তিপ্রিয়। তবে ইদানীং এলাকাবাসী ও পর্যটকরা অভিযোগ করছেন, পঞ্চগড় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলওয়ে স্টশনে অটো-মাইক্রোবাসের এক ধরনের সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যারা রেলস্টেশন থেকে যে কোনো স্পটের ভাড়া কয়েকগুণ বেশি আদায় করছেন।

এক্ষেত্রে রেলস্টেশন থেকে পর্যটন স্পটগুলোর ভাড়া নির্দিষ্ট করা গেলে পর্যটকরা অতিরিক্ত ভাড়া থেকে রেহাই পাবেন। পাশাপাশি পর্যটন স্পটগুলোতে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা স্থাপনের দাবি জানান তিনি।

পঞ্চগড়ের অন্যতম পর্যটন স্পট করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষা দেবীগঞ্জের ময়নামতিরচর ইদানীং মাদকসেবীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি উদ্ভব হয়েছে ফিটিং পার্টির। যারা এ ময়নামতিরচরে ঘুরতে আসা তরুণ-তরুণীদের আটকিয়ে নগদ অর্থ, মোবাইল-স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নিচ্ছে।

নিরাপত্তার বিষয়ে পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, পুলিশ প্রশাসন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। আমার মোবাইল নাম্বার সবার কাছেই দেয়া আছে বা ওয়েবসাইটেও আছে। কেউ কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হলে সেটা যখনই হোক না কেন অবশ্যই পুলিশকে পাশে পাবে। ময়নামতিরচরে মাদকসেবন বা ফিটিং পার্টির বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করবো। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিন্ডিকেট ভাড়ার বিষয়ে পুলিশের যা যা করণীয় সব করা হবে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হওয়ার পরও পঞ্চগড়ে পর্যটকদের জন্য গড়ে ওঠেনি কোনো উন্নতমানের হোটেল বা মোটেল। জেলা শহরে কিছু হোটেল থাকলেও সেগুলোয় নেই উন্নত সুযোগ-সুবিধা। জেলায় বেশকিছু ডাকবাংলো থাকলেও সেগুলোয় পর্যটকদের সংকুলান হওয়া সম্ভব নয়। চলতি বছর রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের উদ্যোগে ঢাকা টু পঞ্চগড় সরাসরি ট্রেন চালু হওয়ায় উত্তরের এ জেলায় যোগাযোগ আরও উন্নত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রেন যোগাযোগ চালু হওয়ায় পঞ্চগড়ে পর্যটনশিল্পের নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। এখন শুধু সরকারি তত্ত্বাবধানে হোটেল-মোটেল তৈরি আর স্পটগুলো সংরক্ষণ করা গেলে পর্যটনে অপার সম্ভাবনাময় হবে হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়।

ডিমলায় তিস্তা সীড্স'র ডিলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত
সিলেটের পর্যটন খাতের উন্নয়নে কয়েক দফা প্রস্তাব

আপনার মতামত লিখুন