শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
গোলাম কিবরিয়ার ভ্রমণ কাহিনী

মহেরা জমিদার বাড়ি : ইতিহাসের অনন্য পাঠ

গোলাম কিবরিয়া
০২ মার্চ ২০২০
মহেরা জমিদার বাড়ি মহারাজ লজ

মহেরা জমিদার বাড়ি মহারাজ লজ

বাংলাদেশ গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অধিকারী। আড়াই হাজার বছরের অধিক সময়ে এ দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, শাসক শ্রেণি গড়ে তুলেছে অসংখ্য ইমারত, নগর, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, বিহার স্তূপ ও সমাধিসৌধ। এসব ঐতিহ্যের অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংস্কৃতির চিহ্ন এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও টিকে আছে, যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সমধিক পরিচিত। এবার ইচ্ছা হলো তেমন কোনো ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন ঘুরে আসি গ্রুপ করে। টিম 'আমার বাংলাদেশ'-এর হয়ে মোট ১১ জন সম্প্রতি ঘুরে এলাম টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী মহেরা জমিদার বাড়ি থেকে। ঐতিহাসিক এই জমিদার বাড়িটি নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর জন্য মানুষের নজর কাড়ে। প্রতিদিনই অনেক মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বেশি থাকে পর্যটকের উপস্থিতি। আমরা গিয়েছিলাম এমনই এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। 'আমার বাংলাদেশ' ট্রাভেল গ্রুপ ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানানোর তাগিদ অনুভব করে দেশের বিভিন্ন জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখার উদ্যোগের কথা ভেবেছিল। সেই ভাবনারই প্রথম প্রয়াস টাঙ্গাইলের মহেরা জমিদার বাড়ি ভ্রমণ।

ঢাকার মহাখালী টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় রওনা হই টাঙ্গাইলের উদ্দেশে। নটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে অটো করে মহেরা জমিদার বাড়ি। মহেরা যাওয়ার পথটি বেশ সুন্দর। গ্রামের মাঝ দিয়ে পিচঢালা পথ বয়ে গেছে। চারপাশটা সবুজে আচ্ছাদিত। মূল ফটকের কাছে এসেই অনুভব করলাম বীরদর্পে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য। টিকিট কেটে আমরা প্রবেশ করলাম। জনপ্রতি টিকিট মূল্য ৮০ টাকা। বাংলাদেশ পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকায় জমিদার বাড়ি ও এর চারপাশের আঙিনা বেশ গোছালো ও পরিপাটি মনে হলো। ১ হাজার ১৭৪ শতাংশ জমির ওপর এই মহেরা জমিদার বাড়ি অবস্থিত। একে একে আমরা দেখে নিলাম ৪টি ঐতিহাসিক ভবন- চৌধুরী লজ, মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, কালীচরণ লজ।

চৌধুরী লজ : জমিদার বাড়ি প্রবেশের পরেই মূল ফটক দিয়ে দেখা যায় চৌধুরী লজ। এটির গোলাপি রংয়ের ভবনটির পিলারগুলো রোমান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছে। সুন্দর নকশা খঁচিত এই ভবনের ভেতরে রয়েছে ঢেউ খেলানো ছাদ। দোতলা বিশিষ্ট এই ভবনটির সামনে রয়েছে সুন্দর বাগান ও সবুজ মাঠ।

মহারাজ লজ : বাইজেনটাইন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মহারাজ লজ ভবনের সামনে ছয়টি কলাম রয়েছে। সেখানে গোলাপি রংয়ের মহারাজ লজের সামনে রয়েছে সিঁড়ির বাঁকানো রেলিং ও ঝুলন্ত বারান্দা, যা ভবনের শোভা বৃদ্ধি করেছে। ভবনটিতে মোট কক্ষ আছে ১২টি, সামনে বাগান ও পেছনে একটি টেনিসসহ কোর্ট রয়েছে।

আনন্দ লজ : মহেরা জমিদার বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভবন হলো আনন্দ লজ। নীল ও সাদা রংয়ের মিশ্রণে ভরা ভবনটির সামনে ৮টি সুদৃশ্য কলাম রয়েছে। তিনতলা বিশিষ্ট ঝুলন্ত বারান্দা এ ভবনকে করেছে আরও দৃষ্টিনন্দন। আনন্দ লজের সামনে হরিণ, বাঘ ও পশু-পাখির ভাস্কর্যসহ একটি চমৎকার বাগান আছে।

কালীচরণ লজ : জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির শেষের দিকে নির্মিত এই কালীচরণ লজ অন্য ভবন থেকে অনেকটা আলাদা। ইংরেজি 'ইউ' (ট) অক্ষরের আদলে এই ভবনটি ইংরেজ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিকেল বেলা ভবনের ভেতর থেকে সুন্দর আলোর ঝলকানি দেখা যায়।

ইতিহাস বলে, ১৮৯০ দশকের আগে স্পেনের কর্ডোভা নগরীর আদলে জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী মহেরা জমিদার বাড়িতে হামলা করে এবং জমিদার বাড়ির কুলবধূসহ পাঁচজন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময় তারা লৌহজং নদীর নৌপথে এ দেশ ত্যাগ করে। এখানেই তখন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এ জমিদার বাড়িটি ১৯৭২ সালে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং পুলিশ ট্রেনিং স্কুলকে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে উন্নীত করা হয় ১৯৯০ সালে।

এই জমিদার বাড়ির সামনে প্রবেশ পথের আগেই রয়েছে 'বিশাখা সাগর' নামে বিশাল এক দীঘি এবং বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ২টি সুরম্য গেট। এ ছাড়াও মূল ভবনে পেছনের দিকে পাসরা পুকুর ও রানী পুকুর নামে আরও দুটি পুকুর রয়েছে এবং শোভাবর্ধনে রয়েছে সুন্দর ফুলের বাগান। বিশাখা সাগর সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে রয়েছে বিশাল আম বাগান ও বিশাল তিনটি প্রধান ভবনের সঙ্গে রয়েছে নায়েব সাহেবের ঘর, কাছারি ঘর, গোমস্তাদের ঘর, দীঘিসহ ও আরও তিনটি লজ।

ছুটির দিনটিতে পরিবারকে নিয়ে এমন একটি স্থানে আপনি ভ্রমণ তাই করতেই পারেন নির্দি্বধায়।

যেভাবে যেতে হবে : ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলগামী বাসে নাটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে অপেক্ষমাণ সিএনজি বেবিট্যাক্সিযোগে (ভাড়া ৭৫ টাকা, শেয়ারে জনপ্রতি ১৫ টাকা) ৩ কিমি পূর্ব দিকে মহেরা জমিদার বাড়ি। মহাসড়কে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, মহেরা, টাঙ্গাইল নামে দিকনির্দেশনা ফলক (বিশাল সাইনবোর্ড) আছে। আর যারা উত্তরবঙ্গ থেকে আসবেন তারা যে কোনো ঢাকাগামী বাসে টাঙ্গাইল পার হয়ে ১৭ কিমি পর নাটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে একইভাবে যেতে পারেন।

দিনটি ঐতিহাসিক!
আমাদের ভাষা আন্দোলন জাদুঘর

আপনার মতামত লিখুন