শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

নারীকে নিয়ে কী বীভৎস মজা

নাছিমা মুন্নী
০৩ জুলাই ২০২০

আমার সামনে আবছা আলো আবছা অন্ধকারে ভেজা ভেজা ব্যস্ত এক শহরের প্রান্ত। এ শহরের ক'জন নারী আমার খুব কাছের বন্ধু। যাদের  স্বামী নেই। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান নিয়ে  যারা স্বামীর বাড়িতেই থাকছেন। একাই কর্মক্ষেত্র,  সন্তান সংসার সব সামলাচ্ছেন। আমাদের সমাজে এসব নারীদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। এসব নারীর জীবনকে কিছু ছকে বাঁধা ফ্রেমে আটকিয়ে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে যুগে যুগে। এমনিতেই কোনো নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করলে সে গভীর দুঃখ কষ্টে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। সে ভাবতে থাকে তার জীবনে হয়তোবা আর সূর্যের ন্যায় আলো আসবেনা। জীবনসঙ্গী হারানোর পর প্রবলভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে তারা। অনেকের জীবনে আনন্দ হারিয়ে যায়। আর এই হারানোর বেদনা সকলকেই কম বেশি ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে।  আর তাই বলে তো জীবন থেমে থাকে না। জীবন হচ্ছে স্রোতের মতো। জীবনীশক্তি থাকলে সে চলতেই থাকবে।  এ সময় তাই মাুনষের সহচার্য দারুণ উপকারে আসে। 

যারা এসব নারীদের হেনস্তা করেন তারা মুখোশ পরা ভদ্রলোক। কখনো এসব মুখোশ পরা মানুষগুলো ফোন করে মজা নিতে চায়। আবার কখনো একা থাকতে খারাপ লাগে কিনা জানতে চায়। নানা কৌশলে শরীরেরও খোঁজ খবর নেয়। এটা এক ধরনের বীভৎস মজা। এভাবেই গুরুত্বহীন, অকিঞ্চিতকর করে যাবতীয় মজা এনে আমরা জড়ো করেছি এই শহরে।

আমি একজন নারীর কথা বলছি, আমি তার নাম দিলাম বৃষ্টি।  এটি তার প্রকৃত নাম নয়, ছদ্ম নাম। বৃষ্টি কলেজের শিক্ষক। তার স্বামীও কলেজের শিক্ষক ছিলেন। স্বামী হঠাৎ করেই মারা যান স্ট্রোক করে। ছেলে দুটো ছোট ছোট। স্বামীর মৃত্যুর দুদিন পরেই পরিবারের সবাই বৃষ্টির সাথে বৈঠকে বসে। বৃষ্টি এবাড়িতে থাকবে নাকি চলে যাবে নানান সিদ্ধান্ত । বৃষ্টির যেহেতু বয়স কম, বাচ্চাগুলো ছোট ছোট, তাই বৃষ্টিকে নিয়ে নানা রকম আলোচনা, পরামর্শ । বৃষ্টি আদৌ একা একা থাকতে পারবে কিনা। একা একা পথ চলতে পারবে কিনা। আবার বৃষ্টি পরে বাচ্চাদের ফেলে চলে গেলে বাচ্চাদের নানান সমস্যা হবে। কে দেখবে বাচ্চাদের। কে দায়িত্ব নেবে বাচ্চাদের। বৃষ্টি নিরবে সবকথা শুনে যাচ্ছিল। অথচ অর্থহীন এই অন্যায় অবমাননা কতক্ষণ সহ্য করবে বৃষ্টি । একদিকে স্বামীর হঠাৎ মৃত্যু তাকে বোবা করে দিয়েছে।  অন্যদিকে তার মৃত্যুর দুদিন না যেতেই তাকে এতো কথা শুনতে হচ্ছে।  তাকে আজ সবাই হিসাবের বাইরে রাখছে কেন? এতো দিন সেইতো ছিল এ পরিবারের মধ্যমণি। স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথেই কি সব একমুহূর্তে পাল্টে যাবে। না এ হতে পারে না। সন্তানগুলো তার। এ ভালোবাসার সন্তানদের রেখে সে কোথায় যাবে। বৃষ্টি শুধু কাঁদে আর কাঁদে। বৃষ্টি জানে মাতৃত্বের এক পৌরানিক গুরুত্ব রয়েছে এদেশে। বাৎসল্যের বাইরে 

সন্তানের বিশেষ অর্থনৈতিক গুরুত্বও আছে এখানে। জীবনের নানা স্তরে নানা সংকটে মানুষ এখানে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য নির্ভর করে সন্তানের ওপর । আবার সন্তান নির্ভর করে মা বাবার ওপর। তাই বৃষ্টির শ্বশুর ছেলের বউকে নাতিদের বিষয়টি চিন্তা করেই ছেলের বউয়ের কথার অগ্রাধিকার দিলেন। বৃষ্টি ছোট ছোট দুটি ছেলে আর শ্বশুরকে নিয়ে তার চলা শুরু করে। কিছু দিনের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে। কিছুদিন পর কলেজের কিছু পুরুষ সহকর্মী  তাকে রাতে ফোন করে ডিস্টার্ব করা শুরু করে। কোনো কোনো পুরুষ  সহকর্মী গরমের মধ্যে বোরকা না পরে শরীরে বাতাস লাগাতে বলছিল। বলার মধ্যে সে বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের টিজিং, পলিটিক্স সব সহ্য করেই টিকে থাকে বৃষ্টি। তার পরিবারের সদস্যদের যেমন তাকে খুশি রাখতে হয় তেমনি কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে কাজের মাধ্যমে টিকে থাকতে হয় বৃষ্টিকে। 

অথচ বৃষ্টি স্বামীর মৃত্যুর পর হঠাৎ করে উজ্জ্বল রঙের শাড়ি আর গয়না সব বাতিল করে দেয়। পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানেও বৃষ্টি বোরকা পরেই উপস্থিত হয়। বোরকাই তার এখন একমাত্র পোশাক। সব জায়গায় তার সাদামাটা উপস্থাপন। তাই যখন কেউ বাজে ইঙ্গিত দেয় তখন বৃষ্টির কাছে এসবের কোনো উত্তর জানা থাকে না। পরিবার, সমাজ তার কাছে অপরিচিত মনে হতে থাকে। সে সবার যেন করুনার পাত্র।

একদিন বৃষ্টি বাজারে গিয়েছিল ইলিশ মাছ কিনতে। পরিচিত মাছওয়ালা। স্বামীর সাথে অনেকবার বাজারে গিয়েছে বৃষ্টি । তাই ঐ মাছ ব্যবসায়ী বৃষ্টিকে ভালো করেই চেনে। বৃষ্টির মাছ পছন্দ হয়নি। তাই মাছ কিনবে না বলে চলে যাচ্ছিল বৃষ্টি । মাছ কিনবে না বলতেই হঠাৎ মাছ ব্যবসায়ী বৃষ্টির দুহাত ধরে টানাটানি শুরু করে। আপা, ভাই নাই তো কি হয়েছে।  আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন। আপনার যে মাছ লাগবে আপনি নিয়ে যান। টাকা না থাকলে পরে দেবেন। সমস্যা নাই। মাছ আপনাকে নিতেই হবে। এদিকে বৃষ্টি তার হাত থেকে যতই হাত ছাড়াতে চাচ্ছেন, পারছেন না। সব মাছ ক্রেতারা এ দৃশ্যটি দেখছিল। সেদিন  বৃষ্টি ঘরে ফিরে এসে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। আর সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছিল অনেকবার। 

বৃষ্টিরা যেমন মূল্যহীন। তাই বৃষ্টির সন্তানদের এ সমাজে অনেক মূল্য দিতে হয় । তাদেরকে আত্মীয়-স্বজন,  পাড়া- প্রতিবেশী সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। কখনো কেউ আদর করে বুকে টেনে নেয় না বরং অনাদর অবহেলা তাদের ভাগ্যে জুটে। 

বৃষ্টির পথ চলা থেমে থাকেনি। রবীন্দ্রনাথ তাইতো লিখেছেন,  যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। সন্তানদের বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছে বৃষ্টি। সন্তানরা তার একমাত্র সহায়। যারা তার বিপদে বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াবে। 

কিছুদিন আগে ফেসবুকে ছ'রঙা শাড়ি পরা ছবির চ্যালেঞ্জ চলছিল। যথারীতি আমিও ছ'রঙা শাড়ি পরা ছবি ফেসবুকে আপলোড করি। আর আমার বন্ধুকে ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ দেই, শাড়ীর চ্যালেঞ্জটি নিতে। সে তার অনেকগুলো শাড়ী পরা ছবি আমার ম্যাসেন্জারে পাঠালো। ছবিগুলো তাদের পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোলা। এরপর সে লিখলো, ছবিগুলো ফেসবুকে দেয়া যাবে না দোস্ত। যেহেতু আমার স্বামী মারা গেছে,  তার সাথে আমার এসব বিলাসিতাও গেছে। আমার ছেলে মেয়েরা দেখলে খবর আছে। তারা চায় আমি খুব সাধারণ মহিলাদের মতো চলি। আমার বোরকাটাও যেন খুব  সাধারণ হয়। ফ্যাশনেবল বোরকাও পরাতেও নিষেধ আছে তাদের। ওরা বলে মায়ের দিন শেষ। আর মেয়ের দিন শুরু। এখন মেয়ে সব ফ্যাশন করবে।

একজন নারীর স্বামীর মৃত্যুর পর সে নারীকে বিধবা বলা হয়। বিধবা শব্দটি আমার বলতে বা লিখতে ভালো লাগে না বলে আমি আমার লেখার কোথাও এ শব্দটি ব্যবহার করিনি। তারপরও লিখতে হচ্ছে লেখার প্রয়োজনে। বেশিরভাগ বিধবা নারী তার সন্তানের সুখ চেয়ে দ্বিতীয় বিবাহ থেকে দূরে থাকে। নিজের জীবন ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে কেবল সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে উপার্জন করে। জীবনটাকে অন্যদের সুখে বিলিয়ে দেওয়াকে স্বাভাবিক বলে মনে করে।  শহর, গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। যে বিবাহিত নারীর স্বামী নেই, তিনি যত বড় শিক্ষিত,  পেশাজীবি হন না কেন তিনি যেন একজন অসম্পূর্ণ নারী। দয়া করে সহানুভূতি নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান, তাদের সঙ্গ দিন।

লেখক : উন্নয়নকর্মী

‘পুঁজিবাজার হবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের কেন্দ্র’
দেশে-বিদেশে মানবতার ফেরিওয়ালা 'সুবর্ণ প্রবাসী ফাউন্ডেশন'

আপনার মতামত লিখুন