মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

শিশুর জীবন যখন বিভীষিকাময়

 নাছিমা মুন্নী
২৮ আগস্ট ২০২০

আমাদের শিশুদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শিশু মনে অনেক প্রভাব ফেলে। যা তারা সারা জীবন বয়ে বেড়ায়। তাই অনেক সময় বড় হয়ে তাদের ভীষণ প্রতিবাদ করার মানসিকতা তৈরি হয়ে ওঠে। কখনো পুরুষ বিদ্বেষী, কখনো নারী বিদ্বেষী হতে তাদের দেখা যায়। কখনো তারা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কখনো ছোট কোনো বিষয়ে তারা খুব প্রতিবাদী হয়ে উঠে। কখনো যৌন বিষয়ে খুব বেশি কৌতূহলী হয়ে ওঠে। আবার বড় হয়ে কখনো নিজের অধিকার বিষয়ে অনেক সময় খুব সচেতন হয়ে ওঠে। কারনে অকারণে প্রতিক্রিয়া জানায়। কেউ কেউ বিভীষিকাময় জীবনের অভিজ্ঞতা সারাজীবন বয়ে বেড়ায়। কারো সাথে মিশতে চায় না ।
বাহিরের চেয়ে অন্তরের অনুষ্ঠানটাই গুরুতর। শিশুকাল মানুষের সর্বপ্রথম শিক্ষাটাই এই- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
একজন শিশু যে অপমানিত হতে পারে, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে, এটা ভুক্তভোগী বা তার পরিবার ছাড়া কেউ ভালো বলতে পারবে না। সে যন্ত্রণাও কেউ বুঝবেনা তাদের মতো করে। একজন শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে সে শিশুর সারাজীবন সেটা রেখাপাত সৃষ্টি করে । ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছের মানুষগুলো সবসময় আতন্কে দিনাতিপাত করতে হয়।
শিশুর যদিও কোনো লিঙ্গ হয় না। তবু আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়ে শিশু, ছেলে শিশু বলে থাকি। মেয়ে শিশুদের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বা যৌন নির্যাতনে অভিভাবকগণ যেভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে আবার ছেলে শিশুর ক্ষেত্রে ঠিক একইভাবে ভেঙ্গে পড়ে।
আমার ছেলেকে পড়াতেন এক আপা। উনার স্বামী অনেকদিন যাবত এবনরমাল চলাফেরা করেন। কারো সাথে ঠিক করে কথা বলেন না। চেনা মানুষকেও ঠিক করে চেনেন না। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। আপা এক কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করতেন। আপা সকালে বের হলে দুপুরে বাসায় ফিরতেন। তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে এক ছেলে তখন সিলেট মেডিকেল কলেজে পড়তো। মেয়েটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। ছোট ছেলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তো।
আপা যখন স্কুলে চলে যেতেন, তখন উনার ছোট ছেলে এগারোটার স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরে, স্কুল ব্যাগ বাসায় রেখে, বাসার পাশেই পাড়ার দোকানে গিয়ে চকলেট, চিপস কিনতে যেত। সে সময়ে অন্য পাড়ার আরেকটা বখাটে ছেলে দোকানে আড্ডা দিতে আসত। আপার ছেলেকে চকলেট, চিপস দিয়ে তার সাথে সে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং আপার বাসায় কে কখন থাকে, কখন থাকে না, সব খোঁজ খবর সে নিয়ে নেয়।
একদিন আপার ছেলেকে বলে, তুমিতো কখনো তোমার বাসায় আমাকে নেওয়া না। তুমি যখন একা বাসায় থাক, তোমার খারাপ লাগে না। আমাকে বললেই তো আমি তোমার সাথে খেলতে পারি, তোমাকে সময় দিতে পারি। তখন আপার ছেলে বললো, তাহলে এখনই চলেন।
বাসায় বখাটে ছেলেটিকে নিয়ে যাওয়ার পর আপার ছেলেকে বললো প্যান্ট খোল। প্যান্ট খুলতে যখন অনীহা প্রকাশ করলো, তখনি ছেলেটা তার প্যান্টের বেল্ট খুলে ওকে মারতে লাগলো। বললো , যা যা করতে বলি, তাই করবি আর আমার কথা কারো কাছে বললে এভাবে শুধু মারবো। এরপর তার সাথে প্রতিদিন যৌন নির্যাতন চালাতো।
আপার ছেলে ভয়ে মাকে বলে না। কয়েক মাস পর ঈদের ছুটিতে আপার বড় ছেলের বন্ধুরা পাড়ায় এলে, আপার ছোট ছেলে বিষয়টি তাদের জানায়। বড় ছেলের বন্ধুরা বখাটে ছেলেটাকে ধমক দিয়ে দেয়। পাড়ায় আসতে বারণ করে দেয়।
এদিকে বখাটে ছেলের সহযোগীরা মিলে আপার বড় ছেলের বন্ধুদের নামে মামলা করে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয় । ছেলেটিকে নাকি আপার ছেলের বন্ধুরা মারধর করেছে এই মর্মে। এতদিন পর আপা বিষয়টা জানতে পারে উনার বড় ছেলের বন্ধুদের মাধ্যমে। আপা কি করবেন ? তার বড় ছেলের বন্ধুরাতো ঈদের ছুটি শেষ হলে তারা তাদের ইউনিভার্সিটিতে ফিরতে হবে। তাদের জন্য হলেও ওনাকে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। তাই উনি মামলা করার জন্য আইনজীবীদের সহায়তা নেয়।
আপা যেহেতু কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চাদের পড়ান, তাই কিছু আইনজীবী অভিভাবকদের সাথে উনার পরিচয় আছে। সেরকম চেনাজানা একজন আইনজীবীর সাথে বিষয়টি আলাপ করলেন। মামলা করলেন। কিন্তু আইনজীবী আর আদালতে ঘুরে উনার বিষয়টা দ্রুত সুরাহা হবে না দেখে, উনি হাল ছেড়ে দিলেন।
একদিন বখাটে ছেলেটার মা-বাবার সাথে দেখা করে কথা বললেন। ছেলেটার মা-বাবা বললেন আমাদের হাতে সময় নেই, আমরা হজ্জ্বে যাচ্ছি। হজ্জ্ব থেকে ফেরার পর আপনার সাথে কথা বলবো।
ছেলে পাড়ায় থাকলে ছেলের ক্ষতি হতে পারে, এই ভয়ে আপা কিছুদিন পর ছেলেকে উনার বড় মেয়ের কাছে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। ছেলেকে গিটার কিনে দিলেন । গান, আবৃত্তি সংগঠনের সাথে ছেলেকে যুক্ত করে দিলেন। যাতে ছেলের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ছেলে ভুলে যায়। একটা সময়ে ছেলেকে সময় দেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে আপা ঢাকায় চলে যান।
আপা পরে ঐ বখাটে ছেলে সম্পর্কে আরো অনেক খবর পায়। সেই বখাটে ছেলেটা এ পর্যন্ত অনেক ছেলের এ সর্বনাশ করেছে। তার টার্গেটের মধ্যে সুন্দর, ফর্সা, নাদুসনুদুস ছেলেগুলো। কোনো কোনো ছেলেরা নাকি স্বেচ্ছায় এখন তার কাছে আসে। যারা এ কাজে আনন্দ পাচ্ছে, তারা। কি সর্বনাশ! কয়েক পাড়ায় এ বখাটে ছেলের বিস্তার। রাতে ছেলে শিশুরা মাগরিব বা এশার নামাজের নাম করে বের হয়ে, তার সাথে মেশে।
আপনার ছেলে শিশুকে একা কোথাও রেখে যাবেন? ছেলে শিশু বলে সে নিরাপদ? তা ভাববার কোনো অবকাশ নেই। বাসার কাজের মানুষ দ্বারাও সে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। কোনো আত্মীয় বেড়াতে এলে, তার দ্বারা নির্যাতনের শিকার হতে পারে। আমি ইউসেফ বাংলাদেশের সহযোগিতায় "লেট চিলড্রেন স্পিক" প্রকল্পে শিশুদের সাথে কাজ করার সময় বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছি । তখন জেনেছি শিশুদের সাথে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ যত ঘটনা। শিশুদের সাথে চিকিৎসকগণ যখন কাউসিলিং করেন, তখন বেরিয়ে আসে ভয়ানক সব ঘটনা। আপনার শিশুটি আপনি ছাড়া কেউ নিরাপদ নয়। সে হোক মেয়ে বা ছেলে শিশু।
আপনার শিশু নির্যাতিত হলে কি করবেন? কার কাছে যাবেন? আইন আপনাকে কতটুকু সাপোর্ট দিবে? আইন আপনাকে কতটুকু নিরাপত্তা দিবে? আইন করে কি সব বন্ধ হয়, হচ্ছে? আইনের জটিলতা, আইনের লম্বা পথ পাড়ি দেওয়াও সবার পক্ষে কি সম্ভব হয়?
পেডোফাইলদের নিপীড়নের শিকার মেয়ে শিশু কখনো ছেলে শিশু। এ জাতীয় ইস্যুতে আইনজীবীদেরও সচেতনভাবে ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। নিপীড়কদের মধ্যে যারা শিশু, তাদের চিকিৎসা করা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন করা উচিত। নিরাপদে থাকুক মেয়ে শিশু-ছেলে শিশু । সমাজ থেকে এসব ব্যাধি নির্মূল করতে সকলের অংশগ্রহণ খুবই জরুরী।
লেখক : উন্নয়নকর্মী

ছয় শর্তে খুললো খাগড়াছড়ির পর্যটন কেন্দ্র
চিরনিদ্রায় জেআইসি স্যুট লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ফখরুল

আপনার মতামত লিখুন