মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
উদয় হাকিমের ভ্রমণ কাহিনী

ক্রিকেট ভক্ত শাহীনের গল্প

উদয় হাকিম, ডাবলিন (আয়ারল্যান্ড) থেকে ফিরে
২৬ মে ২০১৯
আইসিসির নিজস্ব পেইজে প্রকাশিত মোহাম্মদ শাহীনের সেই ছবি

আইসিসির নিজস্ব পেইজে প্রকাশিত মোহাম্মদ শাহীনের সেই ছবি

তিনি হাঁক দিলে উজ্জীবিত হন মাঠের খেলোয়াড়। মাঠে থাকলে জেগে উঠে গ্যালারি। গ্যালারিতে থাকলে ব্যস্ত হয়ে উঠে টিভি ক্যামেরা। হাত নাড়লে জ্বলে উঠে স্টিল ক্যামেরার ফ্লাস। তিনি দাঁড়ালে উচ্চকিত হয় সমর্থকদের কণ্ঠ। তার উপস্থিতি সমর্থকদের জন্য হয়ে উঠে প্রেরণাদায়ক।

এতসব কথা যাকে নিয়ে, তিনি একজন মোহাম্মদ শাহীন। সাদামাটা একজন ক্রিকেট ভক্ত। তাহলে তাকে নিয়ে এত বিশেষণের কী আছে? কারণ সাধারণের মধ্যেই তিনি একজন অসাধারণ।

আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহর এখন বাংলাদেশিদের কাছে পরিচিত নাম। ক্রিকেট পাগল বাংলাদেশিদের প্রথম ত্রিদেশীয় ট্রফি জয়ের শহর। ডাবলিনের দুটি মাঠে হয়েছিল সিরিজের ওয়ানডে ম্যাচগুলো। এর একটি ক্লোনটার্ফ, আরেকটি মালাহাইড।

সিরিজের মাঝপথে গিয়েছিলাম ডাবলিনে। ১১ মে, মালাহাইড গ্রাউন্ডে দর্শক উপস্থিতি ছিল কম। যে কয়জন ছিলেন তাদের মধ্যেও উজ্জীবনী শক্তির ঘাটতি ছিল। কিন্তু ১৩ মে, ক্লোনটার্ফের পরের ম্যাচেই ভিন্ন চিত্র। দর্শক উপস্থিতি কম থাকলেও যে কয়জন ছিলেন, পুরো গ্রাউন্ড মাতিয়ে রেখেছিলেন! গ্যালারিতে বড় করে বাংলাদেশের পতাকা লাগানো। দর্শকরা বেশ উজ্জীবিত, উৎসবমুখর। এর পেছনে ছিলেন ঝাঁকড়া চুলের এক মধ্যবয়সী যুবক! তাকে ঘিরেই উৎসবের আমেজ। আর দর্শক বলতে প্রায় সবাই বাংলাদেশি। কিংবা বাংলাদেশের সমর্থক। উৎসবের মধ্যমণী হয়ে যিনি ছিলেন, তাকে টিভির পর্দায় দেখেছিলাম অনেক। কিন্তু নাম জানতাম না।

আমি গ্যালারিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। পরিচিত হলাম দুজনেই। আসলে দুজনেই দুজনকে চিনি। সেটা টিভির কল্যাণে! ভদ্রলোকের নাম মোহাম্মদ শাহীন। বয়স ৪৭। রীতিমতো একজন ক্রিকেট সেলিব্রেটি। বাংলাদেশ দলের ক্রিকেট ম্যাচ হলেই পর্দায় তিনি থাকবেনই। কিন্তু চলন-বলন, আচরণে কোনো অহংকার নেই। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন। সবার আবদার মেটাচ্ছেন। মুহূর্তেই সবাইকে উজ্জীবিত করছেন। ‘ওই অইতনি’ বলে স্লোগান ধরছিলেন। সবাই বলছিল ‘অইতো’। তিনি বলছিলেন, ‘বাঘ আইলো’। অন্যরা বলছিল, ‘দৌড়া’। আবার শুধরিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘লওড়া না, দৌড়া’! কখনো জোকস বলছিলেন। তিনি অনেকটা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। তিনি জাদুকর শাহীন।

তখন বাংলাদেশ দল ফিল্ডিং করছিল। ইউকেট পড়ছিল না সহজে। মাঠ থেকেই বলছিলেন, ‘আমার চুলের মতো একটা ঝাঁকানাকা বল করেন ভাই, উইকেট দরকার’। হয়তো কাকতালীয়ভাবে তখনই উইকেট পড়ে গেল! আর সবার উচ্ছ্বাস! ভালো ফিল্ডিংয়ের জন্য, চমৎকার ক্যাচ ধরার জন্য, কিংবা ভালো একটা বলের জন্য উৎসাহ দিচ্ছিলেন খেলোয়াড়দের। শাহীনের হাতে ছিল একটি শেকার। সেটা বাজিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন পুরো মাঠ।

ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী শাহীনকে দেখলেই সবাই চেনেন। যেখানেই বাংলাদেশ দল খেলতে যায়, বলা চলে সেখানেই দেখা যায় তাকে। আর টিভি ক্যামেরাও যেন তাকেই খুঁজে! তবে একটা গোপন কথা বলে দিচ্ছি। এই চুল কিন্তু আসল নয়। বললেন, পরচুলা ছাড়া অনেকেই এখন তাকে চেনেন না!

পুরনো ঢাকার বাসিন্দা তিনি। থাকেন গেন্ডারিয়াতে। এক সময় এই গেন্ডারিয়া ছিল ঢাকার প্রাণ। মন্ত্রী-এমপি বা বড়লোকদের বসবাস ছিল। বলা হতো গ্র্যান্ড এরিয়া। সেটা লোকের মুখে মুখে গেন্ডারিয়া হয়ে গেছে।

এক ছেলে, এক মেয়ের বাপ শাহীন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। পেশায় ব্যবসায়ী। বায়িং হাউজ আছে তার, আছে টেক্সটাইল ব্যবসা। ব্যবসাটা নিজের বলে কারো কাছ থেকে ছুটি নিতে হয় না। সেজন্যই এত সময় দিতে পারছেন! কৃতজ্ঞতা জানালেন, বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সবার প্রতি। তারা সুযোগ না দিলে ক্রিকেট নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরতে পারতেন না। ছেলে বলেছিল, ‘একটা ঈদ না হয় তোমাকে মিস করব বাবা, সমস্যা নেই। যাও বাংলাদেশ দলকে উৎসাহ দাও।’ এই বলে পরিবারের প্রতি জানালেন ভালোবাসা।

একসময় ক্রিকেট খেলতেন। ফাস্ট বোলার ছিলেন। মোহাম্মদ রফিক, আমিনুল ইসলাম বুলবুল- এদের সঙ্গে খেলার সৌভাগ্য হয়েছে। বললেন, ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলে বাংলাদেশ। তখন থেকেই তিনি দলকে উৎসাহ দেওয়ার কাজটি শুরু করেন। শুরুটা হয়েছিল নিজের খরচেই।  পরে স্পাইস এফএম ৯৬.৪ তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া শুরু করে। বিমান ভাড়া, থাকা খাওয়া। এসব নিয়ে এখন আর খুব একটা চিন্তা নেই তার।

ডাবলিনে এরপর ১৫ মে খেলা ছিল বাংলাদেশ-ওয়েষ্ট ইন্ডিজ। শাহীন দূর থেকে ছুঁটে আসলেন আমাকে দেখে। মোবাইলফোনে একটি ছবি দেখালেন। দেখেন আইসিসি কি করেছে! শেকার হাতে বড় একটা ক্লোজ ছবি পাবলিশ করেছে আইসিসির নিজস্ব ওয়েব পেইজে। তিনি খুব খুশি! এসবই তো জীবনের পাওয়া। জানালেন, হলুদ রংয়ের ওই শেকার ছাড়াও তিনি মাঠে নিয়ে যান কিউবান পারকিউশন, ব্রাজিলিয়ান ঢোল ইত্যাদি।

১৯৯৩ সালে তিনি চলে গিয়েছিলেন সুইডেনে। সেখানেও ক্রিকেট খেলতেন। দেশ ছেড়ে এত দূরে থাকা ভালো লাগতো। ২০০৬ সালে ফিরে আসেন দেশে। এরপর থেকে আছেন ক্রিকেটের সঙ্গেই। আয়ারল্যান্ড সিরিজ শেষ করেই চলে গেছেন সুইডেনে। থাকবেন ১২ দিন। সেখান থেকে যাওয়ার কথা যুক্তরাজ্যে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে উৎসাহ দিতে থাকবেন মাঠে।

এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে বলা চলে অতি উচ্ছ্বাস শাহীনের। বাংলাদেশ দলের এই (অন্ধ) ভক্তের দাবি-এবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতবে বাংলাদেশ! কীভাবে? এতো অভিজ্ঞ দল আর কখনোই পায়নি টাইগরাররা। এত অলরাউন্ডার আর কোনো দলে নেই। সময়টাও ভালো যাচ্ছে। তার বিশ্বাস, ক্রিকেট বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

তবে দল ভালো না করলেও তার ভালোবাসার কমতি নেই মাশরাফিদেও প্রতি। বললেন, চট্টগ্রামে একবার তখনকার পাকিস্তানের অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম আমাদের আকরাম খানকে বলেছিলেন, ‘তোমরা আগে ব্যাট করো। ’, ‘কেন?’, ‘তাহলে চেজ করতে কম রান করতে হবে। খেলা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। ’ সেই পাকিস্তান এখন আমাদের কাছে অহরহ হারে।

যদিও সব ছাপিয়ে শাহীনের প্রাপ্তি অন্যখানে। একটু ভাবুন, ২৫০ বছর আগে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হবে ব্রিটিশরা কল্পনাও করেনি। ৫০ বছর আগেও আমরা আলাদা দলের কথা ভাবিনি। এখন সেই ব্রিটেনে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজছে, জাতীয় পতাকা উড়ছে। এটাই তো আমাদের কাছে বড় গৌরব!

সত্যিই তো!

বিশ্বকাপ জিতবে বাংলাদেশ!
টেক্সটাইল সেক্টরে অবদানের জন্য ৪ জনকে সম্মাননা দিল সিটাগা

আপনার মতামত লিখুন