বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ | ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অর্থনীতি

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে পর্যটনের নতুন দিগন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৮ জুন ২০২২

বাংলাদেশের পর্যটনে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সাধারণভাবে সময় লাগবে মাত্র ৪২ মিনিট। আর ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে সময় লাগবে ২৭ মিনিট। এখনই ঢাকা থেকে সরাসরি ভাঙ্গা পর্যন্ত এত সহজে যাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর এই সুফল ভোগ করা যাবে।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয় এক্সপ্রেসওয়ে। এটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ দ্বারা পরিচালিত। এটি এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এএইচ১-এর একটি অংশ। এই ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে দুটি সার্ভিস লেন, ৫টি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস, ২টি ইন্টারচেঞ্জ, চারটি রেলওয়ে ওভার ব্রিজ, ৪টি বড় সেতু, ২৫টি ছোট সেতু এবং ৫৪টি কালভার্ট রয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ের দুপাশ সংযুক্ত করা হবে।

পঞ্চান্ন কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েতে পাঁচটি ফ্লাইওভার রয়েছে। এর মধ্যে একটি ২.৩ কিলোমিটার কদমতলী-বাবুবাজার লিংক রোড ফ্লাইওভার। অন্য চারটি ফ্লাইওভার হলো আবদুল্লাহপুর, শ্রীনগর, পুলিয়াবাজার এবং মালিগ্রামে। এক্সপ্রেসওয়ের জুরাইন, কুচিয়ামোড়া, শ্রীনগর ও আটিতে চারটি রেলওয়ে ওভার ব্রিজ রয়েছে।

দীর্ঘ প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর সাথে সংযোগে গড়ে তোলা এক্সপ্রেসওয়ের একপ্রান্ত এসে মিশেছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। পদ্মা সেতু থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটারের মতো এই নয়নাভিরাম চার লেনের সুপ্রশস্ত সড়ক এসে সংযুক্ত হয়েছে এখানে। সেতু প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভাঙ্গার গোলচত্বরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি চমৎকার ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভার কেবল সড়ক চলাচলকে সহজ করছে তাই নয়; বরং এটি এই এলাকার মানুষের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবেও গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন বিকেলে মানুষ সেখানে ভিড় করে মনোমুগ্ধকর সময় কাটানোর আশায়।

একসময়ের নৌপথনির্ভর পুরনো ফরিদপুর জেলার প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র কুমারগঞ্জের নাম বদলে গড়ে ওঠা ভাঙ্গার হাট আজ যেন উন্নত বিশ্বের প্রতিযোগিতায় জৌলুশ ছড়াচ্ছে। ভাঙ্গা গোলচত্বরের এই অত্যাধুনিক ফ্লাইওভার নান্দনিক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। দেখে মনেই হবে না এটি সেই গ্রামীণ জনপদ, যেখানে যাত্রাপথে লেগে থাকত শুধুই ভোগান্তি আর বিড়ম্বনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট আর সরু পথে সড়ক যাত্রার সেই দুর্ভোগের অবসান হয়েছে বিস্ময়করভাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম অগ্রাধিকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের অংশ হিসেবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করা হয় ২০২০ সালের ১২ মার্চ। ২০১৬ সালের মে মাসে এর কাজ শুরু হয়। দেশের প্রথম এই এশিয়ান এক্সপ্রেসওয়ের অংশ হিসেবে ভাঙ্গার গোলচত্বরে গড়ে তোলা হয়েছে এই নান্দনিক ফ্লাইওভার। এর মাধ্যমে বহুলপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা সদর হয়ে উঠবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার।

পদ্মা সেতু চালু হলে ভাঙ্গা থেকে মাত্র ১ ঘণ্টারও কম সময়ে রাজধানীতে পৌঁছানো যাবে। যার ফলে পর্যটনে ঘটে যাবে যুগান্তকারী বিপ্লব। দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন জোরদার করতে পদ্মা সেতুর পাশাপাশি অগ্রণী ভূমিকায় থাকবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। পদ্মা সেতু, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ফ্লাইওভার, লেন এসবই এখন নান্দনিকতায় মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এসব স্থাপত্য পর্যটকে নিজগুণে তো আকৃষ্ট করছেই, পাশাপাশি পদ্মার ওপারের পর্যটনকে করে তুলবে আকর্ষণীয় ও অভিনব।

ভাঙ্গার গোলচত্বর থেকে চার লেনের সুপরিসর চারটি সড়ক চলে গেছে চার দিকে। মাঝে দু’টি ওভারব্রিজ এবং নিচে বিস্তৃত বাইপাস ফ্লাইওভারটিকে নান্দনিক করে তুলেছে। ভাঙ্গা গোলচত্বরের এই ফ্লাইওভারের পশ্চিমে গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনা-বেনাপোল সড়ক, দক্ষিণে মাদারীপুর, বরিশাল হয়ে পটুয়াখালীর পায়রা সেতু হয়ে সাগর-কন্যা কুয়াকাটা, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, মাগুরা, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা পর্যন্ত সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। উত্তর দিকের সড়কটি ফরিদপুর জেলা সদর হয়ে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরের দিকে গেছে। এ সড়ক ধরেই দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি পার হয়ে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাওয়া যায়।

পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা যেতে সময় লাগবে ৪০-৪৫ মিনিট। আগে লাগত পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। পদ্মা সেতু চালু হলে এই মোড় ব্যবহার করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানীর সাথে। এতে সংযোগ সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র মংলা, পায়রা ও বেনাপোল বন্দরের। এই পথে সড়কের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে রেল যোগাযোগ। বর্তমানে এক্সপ্রেসওয়ের পাশ দিয়েই চলছে এই রেল সড়ক নির্মাণের আরেক মহাযজ্ঞ।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে যখন নৌপথই ছিল চলাচল ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম, সেই আমলে আজকের ফরিদপুর, টেকেরহাট, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর এলাকার কুমার নদীতীরবর্তী ব্যবসায়িক অঞ্চল তথা গঞ্জ হিসেবে গড়ে উঠেছিল কুমারগঞ্জ। কুমার নদীর দুই পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকাও গড়ে উঠেছিল এই কুমারগঞ্জকে কেন্দ্র করে। এ ইতিহাস আজ থেকে প্রায় শত বছর আগের। তবে দেশ স্বাধীনের আগে হঠাৎ করেই একদিন কুমারগঞ্জের কুমার নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দাদের মাঝে হাট নিয়ে গণ্ডগোল বাধে। এরপর নদীর দক্ষিণের গঞ্জ ছেড়ে উত্তরের মানুষেরা নদীর এ পারে গড়ে তোলে কুমারগঞ্জ ভাঙ্গার হাট। মুখে মুখে এটি ভাঙ্গার হাট বা ভাঙ্গার বাজার নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এভাবেই ভাঙ্গার নামকরণ বলে জানা গেছে। এই ভাঙ্গা প্রথমে একটি থানা এবং পরবর্তী সময়ে উপজেলা সদরে রূপ লাভ করে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ পথে ঢাকার সাথে মাওয়া ফেরিঘাট হয়ে খুলনা জেলার সাথে সংযোগ স্থাপনকারী এশিয়ান হাইওয়ে নির্মিত হওয়ার পর দুই হাজার সালের প্রথম দিকের সময় থেকেই ভাঙ্গা উপজেলার গুরুত্ব বাড়তে থাকে।

এক পদ্মা সেতুতেই বদলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিত্র। এর ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ভ্রমণপিয়াসীদের পরিবহনে আর আগের মতো ফেরি পার হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ভোগান্তি পোহাতে হবে না। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে। ভাঙ্গা অঞ্চলকে ঘিরে একটি ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ভাঙ্গায় পদ্মা সেতু জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া ভাঙ্গায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক মান মন্দির ও তাঁতপল্লীসহ নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এখন সারা দেশের নজরে এশিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে। জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য। পদ্মা সেতু চালু হলে ফরিদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সাথে রাজধানীর যোগাযোগ সহজ হবে শুধু তাই নয়; এইসব জেলায় পর্যটনের নব দিগন্তের সূচনা হবে। ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার তো ঘটবেই এবং এখানকার মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবেও, সেই সাথে ২১ টি জেলায় পর্যটনের সমূহ উন্নতি হবে। যে কুয়াকাটা যেতে মানুষকে দীর্ঘ পরিকল্পনা করতে হতো এখন চাইলেই চলে যাওয়া যাবে সাগরকন্যার অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে। এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নত পর্যটন দেশের জাতীয় আয় তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।

বিনামূল্যে বাড়তি সেবা এবং বিশেষ ছাড় দিচ্ছে ‘ভিভো’
অতিদ্রুত গলছে হিমবাহ : এভারেস্ট বেসক্যাম্প সরিয়ে নিচ্ছে নেপাল

আপনার মতামত লিখুন