শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ | ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয়

সুফল পেয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৭৯০ কৃষক

এক প্রকল্পেই বদলে গেছে তিন জেলার কৃষি

২০ বছরের জলাবদ্ধ জমিতে তিন ফসলের হাসি

নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ অক্টোবর ২০২৩
বিলুপ্ত খাল খননে সেচ সুবিধা পাচ্ছেন কৃষক। দূর হয়েছে জলাবদ্ধতা

বিলুপ্ত খাল খননে সেচ সুবিধা পাচ্ছেন কৃষক। দূর হয়েছে জলাবদ্ধতা

কুমিল্লার বুড়িচংয়ের বিস্তীর্ণ কৃষি মাঠ পয়াতেরজলায় তিন একর জমি ছিল আব্দুল হকের। এ জমিতে বছর পাঁচেক আগে আউশ ধান চাষ করেছিলেন তিনি। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এক ছটাক ধানও তিনি ঘরে তুলতে পারেননি। শুধু আব্দুল হক নন, এ এলাকার ৫ হাজার কৃষকের ১২ হাজার জমি ২০ বছর ধরে ডুবছে। বুড়িচং উপজেলার সদর, বাকশীমুল, ষোলনল ও রাজাপুর ইউনিয়নের বিশাল অংশের দুঃখ ছিল পয়াতের খাল। অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে অস্তিত্ব সংকটে ছিল ঘুংঘুর ও পাগলী নদীর শাখা ‘পয়তের খাল’। নিষ্কাশনের অভাবে পানি বের হতে পারে না। ফলে কখনও জলাবদ্ধতা, কখনও সেচের অভাবে অনাবাদি থাকে জমি। ছিল জোঁকের উপদ্রব, কচুরিপানা আর আগাচায় ভরে থাকতো মাঠ। কৃষকের জন্য বিষফোঁড়া হিসেবে পরিচিত সেই পয়তের খালে এখন প্রাণ ফিরেছে। 

২০১৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেচ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। ৩৪ উপজেলায় ৩৬৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প চলবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। ২০২০ সালের ড্রোন উড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় পুরো এলাকা। কোথায় জলাবদ্ধতা কিংবা পানি আটকে আছে তা চিহ্নিত করা হয়।  সে প্রল্পের অধীনে দখল মুক্ত করে ২০২১ সালের শুরুতে ২৫ কিলোমিটার খাল পুনর্খননের উদ্যোগ নেয় বিএডিসি। এতে ক্ষতি ও দুঃখ-কষ্ট ছাপিয়ে বুকভরা আশায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বুড়িচংয়ের কৃষক। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে সেখানে আউশের ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। এসব অনাবাদী জমিতে ফলছে অন্তত ৩০ হাজার টন ফসল।

শুধু পয়াতের জলা নয়- কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরের ২৬ হাজার ৯৩৯ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৬১৭ কিলোমিটার মরা খাল খনন করা হয়েছে। ৪০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও ১৯ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ডেনেজ পাইপ নির্মাণ হয়েছে। ৪১২ কিলোমিটার ভূ-গর্ভস্থ সেচনালা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ৩০টি সৌর চালিত পাতকূয়া, ১১৪টি বিদ্যুৎ চালিত এলএলপি, ৫০টি সাবমারসিবল পাম্প নির্মাণ হয়েছে। এতে প্রকল্প এলাকায় প্রতি বছর ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৫ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। সুফল পেয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৭৯০ জন কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগে তিন জেলায় ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমি চাষের আওতায় ছিল। খাল খনন ও সেচ সুবিধার কারণে এখন চাষের আওতা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৮২৫ হেক্টর। তিন জেলায় আগে প্রায় ২২ লাখ টন শস্য উৎপাদন হতো, তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৫ টন। 

বুড়িচংয়ের পয়াতেরজলায় এখন চারদিকে আউশের সোনালি আভা। বাতাসে ধানগাছের পাতা দোল খাচ্ছে আর ছড়াচ্ছে হালকা মিষ্টি সুবাস। ক্ষেতের একদিকে কৃষক ধান কাটছেন, আরেক দিকে চলছে ধান মাড়াই। খনন করা খালে মাছ ধরছেন কেউ কেউ।

বুড়িচংয়ের রাজাপুর ইউনিয়নের কৃষক আতিকুল ইসলাম বলেন, দুই বছর আগেও এখানে কোমরপানি ছিল। দীর্ঘদিন এই জলায় আউশ ধান হতো না। কখনও আমন ধানও নষ্ট হয়ে যেত। শুধু বোরো চাষ করা যেত। একসময় অভিশাপের মতো ছিল। বিএডিসি খাল খনন করায় জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে।

বুড়িচংয়ের হরিপুর গ্রামের গিয়াস উদ্দিন মাস্টার বলেন, খাল খননে জমিতে ফসল হচ্ছে, খালে মাছ ধরা যাচ্ছে। খালের পাড়ে হাঁটাচলার রাস্তাও হয়েছে। সেখানে বিএডিসি কাঠ ও ফলের গাছ লাগিয়েছে। সেগুলো ফলও দিচ্ছে, কৃষকদের ছায়াও দিচ্ছে।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) কুমিল্লা উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে আগে আউশ ধান হতো না। এখন আমরা বিনা-১৯ ও বিনা-২১ চাষ করছি। ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে।  

কুমিল্লার চান্দিনার কাজীপাড়া খাল ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কানাইল খাল খনন করায় এতে হাসছে ২ উপজেলার প্রায় ৩ হাজার কৃষক। অন্য দিকে দাউদকান্দির পাদুয়া ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কারণে আবাদে ফিরেছেন কয়েক হাজার কৃষক। বাঁধটি ঘিরে বর্ষায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া তিনটি গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। এখন আর নৌকায় চলাচল করতে হয় না। দাউদকান্দির বড় হরিণা রামায়েতকান্দিতে ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ পাইপের কারণে কচুরিপানা ও জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছেন বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষক।

চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পালাখাল ইউনিয়নের মেঘদাইর গ্রামের দেড় কিলোমিটার সুন্দরী খাল ৫০ বছর ধরে সংস্কার না করায় পলি ও কাদা জমে ভরাট হয়েছিল। ফলে বর্ষার পানিতে ডুবে থাকতো ওই এলাকার প্রায় ৪০০ একর কৃষি জমি।  খালটি সংস্কার করায় হাসি ফুটেছে স্থানীয় কৃষকদর মুখে। সঠিক সময়ে ফসল ফলানোর আশায় বুক বেঁধেছেন তারা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের সাতপাড়া এলাকায় ভরাট খাল খননের কারণে ১০০ বিঘা জমিতে পানি নিতে পারবেন কৃষকেরা। 

কুমিল্লা (ক্ষুদ্রসেচ) সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও বিএডিসির কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রকল্প বাস্তবায়নে সেচে বেড়েয়েছেন প্রতিটি এলাকা। উন্নয়ন কাজের মানে কোনো ছাড় দেননি। তাইতো কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রকল্প এলাকায় গেলেই প্রসংশার জোয়ারে বাসছেন। ছুটে আসেন কৃষকরা। অকপটে সুফলভোগের কথা তুলে ধরেন।  

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ভূউপরিস্থ সেচের পানির প্রাপ্যতা বাড়াতে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল সচল করা জরুরি। আমরা প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তিনটি জেলার খাল, জলাভূমি, ব্রিজ-কালভার্ট পর্যবেক্ষণ করেছি। সে অনুযায়ী অনবাদি জমিতে তিনটি ফসল ফলাতে যেখানে যা দরকার তা করেছি। এতে জমিগুলোর ফসল তিনগুন বেড়েছে। সার্বিকভাবে দেশের খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় এসব জমি ভূমিকা রাখবে।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কুমিল্লায়, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক সময়ের জলাবদ্ধ জমিতে সোনালী ফসলের ঝিলিক আমি সরেজমিন দেখে এসেছি। কুমিল্লার প্রকল্পটি সারাদেশের জন্য অনুকরনীয় হতে পারে। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় পানির প্রবাহ কমে গেছে। অনেক খাল পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। খাল খননের ফলে এক দিকে জলাবদ্ধতা দূর হবে, অন্য দিকে শুকনো মৌসুমে খালের পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা যাবে।

৩২ মিলিয়ন ডলারের ফ্রিজ, এসি ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্স রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি

আপনার মতামত লিখুন