শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ | ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয়

প্রাণিসম্পদে আইন প্রণয়নে বাধা অবৈধ সুবিধাভোগীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ ডিসেম্বর ২০২৩
 হাবিবুর রহমান মোল্লা

হাবিবুর রহমান মোল্লা

দীর্ঘ দিনের দাবির মুখে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ‘অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি (পশু পালন) কাউন্সিল’ আইন ২০২৩ গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে। গত সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশিদের সভাপতিত্বে সভায় আইনটি প্রণয়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এসোসিয়েশন (বিডিএফএ) ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিস সেন্ট্রাল কাউন্সিলসহ (বিপিআইসিসি) বিভিন্ন সংগঠন। তবে উদ্যোগটি ঠেকাতে একটি মহল উঠে পড়ে লেগেছে। বিশেষ করে প্রাণিসম্পদ খাতে দীর্ঘ দিন ধরে টেন্ডার-নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরাই হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইন ঠেকাতে মাঠে এখন সক্রিয়। অনেককে ভুল বুঝিয়ে তারা ইতোমধ্যে আন্দোলনেও নামিয়েছেন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পশু পালন ও জাত উন্নয়নে অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি ডিগ্রিধারীদের বড় অবদান আছে। কিন্তু তাদের জন্য নেই কোনো কাউন্সিল। অথচ প্রাণিসম্পদ খাতে ভেটেরিনারি কাউন্সিল আছে। ফলে সরকার ভেটেরিনারি কাউন্সিলের পাশাপাশি হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার বন্ধের শঙ্কায় বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের (বিভিএ) মহাসচিব ডা. হাবিবুর রহমান মোল্লার নেতৃত্বে একটি মহল প্রাণিসম্পদ খাতে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সম্ভাবনাময় খাতটি। 

অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইনকে অপ্রয়োজনীয় আখ্যা দিয়ে গত সোমবার রাজধানীর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে প্রতিবাদ সভা করেছে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন (বিভিএ)। সভায় এসোসিয়েশনের মহাসচিব ড. হাবিবুর রহমান মোল্লাকে অগ্রভাগে দেখা যায়। অভিযোগ রয়েছে, হাবিবুর রহমান মোল্লা দীর্ঘ দিন সংগঠনের পরিচয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি ও তদবির করে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান এথেনা এন্টারপ্রাইজ ও হেসপার ফার্মার নামে কাজ ভাগিয়ে নিচ্ছেন। হাবিবুর রহমানের অনুসারীদের মহড়ার কারণে অনেক ঠিকাদার দরপত্র কিনতে পারেন না। তার ভাড়াটে লোকজন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে নিয়মিত মহড়া দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) গরু সরবরাহের দরপত্রেও প্রভাব খাটিয়েছেন হাবিবুর রহমান মোল্লা। গরু সরবরাহের ঠিকাদারি সর্বনিম্ন দরদাতাকে না দিয়ে তাকেই দেওয়া হয়। এ নিয়ে খামারিদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খামারি বলেন, হাবিবুর রহমান মোল্লা তার দুই প্রতিষ্ঠান এথেনা এন্টারপ্রাইজ ও হেসপার ফার্মার নামে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বাণিজ্য করছেন। তার প্রতিষ্ঠানের সরবরকৃত কৃমিনাশক, ভিটামিন, এন্টিবায়োটিকসহ নানা ওষুধ খুবই নিম্ন মানের। এ বিষয়ে বার বার অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। এতে দেশের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এবং প্রান্তিক খামারিরা প্রতারিত হচ্ছেন। মাঠ থেকে তার ওষুধ সংগ্রহ করে নমুনা পরীক্ষা করলে প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, হাবিবুর রহমান মোল্লা বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সুবিধা আদায়ে মরিয়া হয়ে থাকেন। স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। কয়েক মাস আগে এলডিডিপি প্রকল্প থেকে সুবিধা না পেয়ে তার অনুসারীদের দিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেন।

অভিযোগ রয়েছে, এক সময় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে লাল রংয়ের একটি ভবন ছিল। দীর্ঘ দিন ভবনটি হাবিবুর রহমানসহ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের কয়েকজন নেতার দখলে ছিল। ভবনে রুম ভাড়া দিয়ে চলেছে বাণিজ্য, খালি জায়গায় করা হয় রেস্তোরা। 

হাবিবুর রহমান মোল্লার এ সকল অবৈধ কার্যক্রমের পেছনে সার্বক্ষণিক পরামর্শ প্রদান করছেন ড. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ। যিনি ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমানের আস্থাভাজন হয়ে চট্টগ্রামে সরকারি কলেজ এর প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে উক্ত কলেজ ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ভেটেনারি বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর করে উক্ত মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে উপাচার্য নিযুক্ত হন। উল্লেখ্য ড. নিতীশ চন্দ্র দেবনাথ এর প্ররোচনায় ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সভায় ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি ফ্যাকাল্টি এক করে পাকিস্তানি মডেলের বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স এন্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রী কম্বাইনড ডিগ্রি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভায় বাতিল হয়ে যায়।

বর্তমানে তৎকালীন বিএনপি সরকারের ওই এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করার জন্য ড. নীতিশের প্ররোচনায় হাবিবুর রহমান মোল্লা দেশের নির্বাচনকালীন এই সময়ে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করছে। তার সহধর্মিণী প্রফেসর ড. নাসরিন সুলতানা জোয়েনাকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি ও প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে চাপ সৃষ্টি করছে। হাবিবুর রহমান মোল্লা কর্মকর্তা না হয়েও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরেরঅর্গানোগ্রাম কমিটিতে সদস্য ছিলেন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রী কাউন্সিল আইন গঠনে সুবিধাভোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন এমন ভয়ে আইনটি বাতিলের আন্দোলনে নেমেছেন। তবে আইন প্রনয়নে মন্ত্রণলায় কঠোর অবস্থানে আছে বলে জানা গেছে। 

বাংলাদেশ এনিমেল হাজবেন্ড্রি এসোসিয়েশনের (বাহা) সভাপতি ও সাবেক সচিব জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, সারা পৃথিবীতে দুটি আলাদা আলাদা আইন আছে। বাংলাদেশে শুধু ভেটেরিনারি কাউন্সিল আইনের কারণে প্রাণির চিকিৎসা ও উৎপাদনের ক্ষমতা রাখেন ভেটেনারি গ্রাজুয়েটরা। দুটি আইন হলে এনিমেল হাজবেন্ড্রী গ্রাজুয়েটরা ক্ষমতা পাবেন। এতে তারা উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন। অথচ একটি গোষ্ঠী পুরো খাতটি নিজেদের দখলে রাখতে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অথচ হাজবেন্ড্রী কাউন্সিল আইন গঠন হলে তাদের ক্ষমতা খর্ব হবে না। এটি গঠন হলে কিছু ব্যক্তির ফায়দা লোটার অপপ্রচেষ্টা বন্ধ হবে। 

বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের (বিভিএ) মহাসচিব ড. হাবিবুর রহমান মোল্লা বলেন, এখানে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। বরং সচিব যা ইচ্ছে তাই করছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল এক্টের আওতায় সারাদেশে প্রাণিসম্পদের অগ্রগতি ও উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এখানে নতুন করে আরেকটি আইনের প্রয়োজন নেই।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ বলেন, প্রান্তিক খামারিসহ এ খাতের সবার দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল হাজবেন্ড্রী কাউন্সিল আইন করার। হাজবেন্ড্রী গ্র্যাজুয়েটরা প্রাণিপুষ্টি, খামার ব্যবস্থাপনা, প্রজনন, বায়োসিকিউরিটি, ফুড সেফটি, প্রাণিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সর্বোপরি পশুর জাত উন্নয়ন ও উৎপাদন নিয়ে কাজ করে থাকে। আর ভেটেরিনারি গ্রাজুয়েটরা প্রাণির চিকিৎসা নিয়ে কাজ করেন। ভেটেরিনারি কাউন্সিল আইনের কারণে হাজবেন্ড্রি গ্র্যাজুয়েটদের কোনো স্বীকৃতি নেই। তারা পদে পদে বঞ্চিত ও শোষিত ছিল। প্রাণিসম্পদ খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতেই দুটি আলাদা কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যুগান্তকারী এ উদ্যোগটি প্রতিহত করতে একটি গোষ্ঠী নানা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

জানা যায়, অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি ডিগ্রি অত্যন্ত পুরাতন এবং প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে যুগোপযোগী একটি ডিগ্রি। এই ডিগ্রির হাত ধরেই বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের ক্রমবর্ধমান বিকাশ হয়েছে, ফলে প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্রয়লারের গোশত তথা প্রাণিজ আমিষের জোগান নিশ্চিত হয়েছে। এই ডিগ্রিধারীদের জন্য আইনি কাঠামো অত্যন্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশ অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি অ্যাসোসিয়েশনের চলতি বছরের মে মাসে মাসে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি)-তে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশ অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইন করা প্রয়োজনের কথা তুলে ধরা হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রী ইতিবাচক মতামত প্রদান করেন। এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ভেটেরিনারি চিকিৎসকদের পাশাপাশি দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি (পশু পালন) ডিগ্রিপ্রাপ্তরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু তারাও ভেটেনারি কাউন্সিল আইনের আওতায় থাকায় উৎপাদন ও জাত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এবার অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য আলাদা কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইন গঠনের মাধ্যমে এই বিশেষজ্ঞ গ্র্যাজুয়েটদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

এভন অ্যানিমেল হেল্পের নির্বাহী সহসভাপতি মো. মাহবুব হাসান জানান, দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে খামারি অ্যাসোসিয়েশন ও বিভিন্ন অংশিজনদের দীর্ঘদিনের চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি পেশাজীবীদের আইনগত কাঠামো ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনার লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে করে দেশের প্রাণিপুষ্টি, খামার ব্যবস্থাপনা, অ্যানিমেল প্রজনন ব্যবস্থাপনা, বায়োসিকিউরিটি, ফুড সেফটি, প্রাণিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

এ দিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনিমেল হাজবেন্ড্রি অনুষদ ছাত্র সমিতি গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে এনিমেল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইনের বিকল্প নেই। অথচ একটি কুচক্রী মহল ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারের এ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

একজন প্রখ্যাত বিদগ্ধ আলেমেদ্বীনের প্রস্থান
সেরা করদাতা সম্মাননা ও জাতীয় ট্যাক্স কার্ড পেলেন ওয়ালটনের ৩ উদ্যোক্তা পরিচালক, ওয়ালটন প্লাজা

আপনার মতামত লিখুন