শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪ | ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ইভেন্ট

টিউলিপ ফুলকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

শীত প্রধান দেশের ফুল টিউলিপ। কিন্তু গরমের দেশে শীতের এই ফুল ফোটানোর সাহস প্রায় অবাস্তবই ছিল। বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশে প্রথম টিউলিপের হাসি ফুটিয়েছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া পূর্ব খণ্ডগ্রামের ফুলচাষি দেলোয়ার হোসেন ও সেলিনা আক্তার। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে টিউলিপ ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েছেন ওই দম্পতি। এবারই প্রথম নয়, এ নিয়ে টানা তৃতীয়বার। এবার তাদের বাগানে ফুটেছে প্রায় ১৩ রঙের টিউলিপ।

গত বছর তাদের বাগানের টিউলিপ ফুল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর কেড়েছিল। ওই বছর বাগান পরিদর্শনে এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর ফুলচাষি দেলোয়ার হোসেন ও সেলিনা আক্তার দম্পতির টিউলিপ ফোটানোর খবর বাংলাদেশের সব মিডিয়ায় প্রচার হয়েছিল। বাদ যায়নি ডাচ মিডিয়ায়ও।

এ ছাড়া, চলতি মাসের ৩ তারিখে ফুলচাষি দেলোয়ারের টিউলিপ বাগান ঘুরে গেলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত (ভারপ্রাপ্ত) পাওলা রোস সিনড্রেলা। বাংলাদেশে এমন একটি নান্দনিক টিউলিপ ফুলের বাগান দেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্য নিজের দেশের পরিচিত টিউলিপ রাজ্যে হারিয়ে যান বলে মন্তব্য করেন এবং দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী সেলিনা হোসেন শেলীর পরিশ্রম ও সাফল্যের প্রশংসা করেন। তবে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে টিউলিপ ফুল চাষে তার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানা সহযোগিতার ব্যাপারেও কথা বলেন। নেদারল্যান্ডস থেকে খুব সহজেই যেন বীজ আমদানি করা যায়, সে ব্যাপারেও সহায়তা করা হবে বলেও সিনড্রেলা আশ্বাস দেন।

দেলোয়ার হোসেন ও সেলিনা আক্তার দম্পতির প্রতিষ্ঠানের নাম মৌমিতা ফ্লাওয়ার। এর আগে জার্বেরা, চায়না গোলাপ ও বিদেশি বিভিন্ন ফুল চাষে সফল হয়েছেন তিনি। সফল ফুলচাষি হিসেবে ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পান দেলোয়ার। প্রথমবার ২০২০ সালে নেদারল্যান্ড থেকে ২০ হাজার বাল্ব (বীজ) আমদানি করে সীমিত পরিসরে কৃষক দেলোয়ার তার বাগানে টিউলিপের চাষ করেন। এরপর ২০২১ সালে ৩০ হাজার এবং এ বছর ৭০ হাজার বাল্ব আমদানি করেছেন তিনি। তবে করোনার কারণে প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হচ্ছে দেলোয়ারকে।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, দেশে টিউলিপের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। আমার বাগানে পরপর দুবার টিউলিপ ফোটায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। সেই চিন্তা থেকে এবার নেদারল্যান্ডস থেকে হলুদ ও লাল, চার ধরনের গোলাপি, কমলা, সাদা, পার্পেল রঙেরসহ ১০ ধরনের ৭০ হাজার টিউলিপের বাল্ব (বীজ) আমদানি করেছি। ১৩ রঙের টিউলিপ নিয়ে কাজ করছি। তার মধ্যে ৬টিতে সাফল্য এসেছে। আমদানি করা বাল্বগুলো থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ৪০ হাজার, রাজশাহীতে ১ হাজার ও যশোরের গদখালিতে ৫ হাজার বাল্ব দিয়ে বাগান তৈরি করে দেশের টিউলিপের এলাকা নির্ধারণে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সব জায়গায় টিউলিপ ফুল ফোটায় এ নিয়ে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে পঞ্চগড়ে। কারণ সেখানকার তাপমাত্রা তুলনামূলক দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে কম।

তিনি আরও বলেন, কৃষি সম্প্রসারণের লোকজন আমাদের সবসময় সহযোগিতা করেন। তবে আমাদের দরকার অবকাঠামোগত সহযোগিতা। বাগান তৈরিতে যেসব নেট ব্যবহার করা হয়, সেসবের উপর ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো প্রয়োজন। নেদারল্যান্ডস থেকে বাল্ব (বীজ) আনতে অনেক টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে যদি সহযোগিতা করা হয়, তাহলে শুধু টিউলিপ নয়, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফুল ও সবজি চাষ করা সম্ভব দেশে।

মৌসুমে বাগান থেকে যে কেউ চাইলে টিউলিপ ফুল নিতে পারেন। একটি ফুল বিক্রি করা হচ্ছে ১০০টাকায়। আর টবে করে ফুল নিতে পারবে ২০০ টাকায়। এ ছাড়াও, যারা ফুল দেখতে আসছেন, তাদের জন্য প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা বাগানে এসে ফুলের সঙ্গে ছবি তুলতে পারবেন।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাগান করতে আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন আমার স্ত্রী সেলিনা আক্তার। সে ইংলিশে অনার্স-মাস্টার্স করেছে। এ কারণে বিদেশি বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে বাল্ব সংগ্রহ করে সে। ফুল চাষ করতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলে সেটি নিরসনে বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমার স্ত্রী।

সেলিনা আক্তার বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ফুল চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠলেও আমরা পিছিয়ে। অর্থনীতি ও চাহিদার কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিদেশি ফুল দিয়ে আমাদের স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়। এরই মধ্যে জার্বেরা, চায়না গোলাপের পর বিদেশি টিউলিপ ফুল ফুটিয়ে এসেছে একের পর এক সফলতা। এখন হলো সম্প্রসারণের কাজ করে যাওয়া।

তিনি আরও বলেন, নেদারল্যান্ডস টিউলিপ ফুল উৎপাদনকারী প্রধান দেশ। টিউলিপকে নিয়েই সেখানে গড়ে উঠেছে শিল্প। সেখানে প্রতি বছর পালন করা হয় টিউলিপ উৎসব। সাধারণত মার্চ-এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ ফুল ফোটে। তবে বিস্ময়ের বিষয় বাংলাদেশে এই ফুল ফুটছে দু’মাস আগেই। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের টিউলিপ ফুল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির আশা জাগাচ্ছে। এ ছাড়াও, দেশের শীতপ্রধান জেলাগুলোতে যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে টিউলিপ চাষ করা যায়, তাহলে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। দেশের মানুষ তখন অনেক টাকা খরচ করে টিউলিপ দেখতে কাশ্মির, নেদারল্যান্ডে যাবে না। তাই সরকারকে টিউলিপের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দৃষ্টিনন্দন টিউলিপ সুভাস ছড়াচ্ছে। বাহারি রঙের টিউলিপ দেখে যে কারো মন পুলকিত হবে। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে দেলোয়ারের বাগানে ফুটতে শুরু করে এই টিউলিপ ফুল। এখন সব ফুল ফুটে দৃষ্টি জুড়াচ্ছে দর্শনার্থীদের। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশুরা দেলোয়ারের বাগানে আসছেন টিউলিপ দেখতে। তবে দর্শনার্থী সীমিত করতে দেলোয়ার হোসেন এবার প্রবেশ ফি নির্ধারণ করেছেন ১০০ টাকা। দর্শনার্থীরা নিজেদের মোবাইলে ধারণ করছেন টিউলিপের চিত্র। আর টিউলিপময় এ ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ নিয়ে তৃতীয়বার টিউলিপ ফুল ফোটায় দর্শনার্থীদের আগমনও বেড়েছে।

মহাখালির ডিওএইচএস থেকে ছেলেকে নিয়ে টিউলিপ বাগান দেখতে গিয়েছিলেন বিথি আক্তার। তিনি বলেন, আগে আমরা দেশের বাইরে যেতাম টিউলিপ বাগান দেখতে। যখন ফেসবুকে দেখলাম বাংলাদেশেই টিউলিপের বাগান হয়েছে, তখন থেকেই আসার পরিকল্পনা করি। আমার ছেলেও টিউলিপ ফুল অনেক পছন্দ করে। তাই তাকে নিয়ে সকাল সকাল বাগানে চলে এসেছি। দেশের মাটিতে টিউলিপ ফুটছে দেখে অনেক ভালো লাগছে।

কৃষি অধিদপ্তর ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক বশির আহমেদ সরকার বলেন, বাংলাদেশে টিউলিপ খুব একটা চাষ হতো না। শ্রীপুরের দেলোয়ার হোসেন ব্যক্তিক্রমধর্মী একটা উদ্যোগ নিয়েছেন এবং উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি টিউলিপের চাষ বাড়াচ্ছেন। টিউলিপ একটি মূল্যবান এবং সিজনাল ফুল, যে কারণে এটি শীতকাল ছাড়া হয় না। তবে শ্রীপুরের দেলোয়ার হোসেনকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টিউলিপের চাষ বাড়ছে।   

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ টিউলিপের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যত রকম প্রযুক্তিগত পরামর্শ আছে, তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। সরকারও এ ব্যাপারে অবগত আছেন। আর ভ্যাট ও ট্যাক্সের বিষয়টি নির্ধারণ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে একটি সঙ্গনিরোধ উইং আছে। আর সঙ্গনিরোধ উইং থেকে কিভাবে সাপোর্ট করা যায় এবং ইমপোর্টের ক্ষেত্রে কিভাবে সহজিকরণ করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা সহযোগিতা করবো।

ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি কাউন্সিলের নেতৃত্বে হেলাল-শামীম
চার কর্মীর পরিবারকে মৃত্যুজনিত অনুদান দিলো ওয়ালটন

আপনার মতামত লিখুন