শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঘুরে আসি

ফুলের রাজ্য গোলাপ গ্রাম

আবীর বসাক
১৯ জানুয়ারি ২০২২

ফুলের প্রতি মানুষের চাহিদা এবং আকর্ষণ অনেক আগে থেকেই। যে কোনো উৎসব আয়োজন কিংবা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ফুলের কদর থাকে আকাশচুম্বী। প্রিয়জনকে উপহার দিতে জুড়ি নেই একগুচ্ছ ফুলের। তবে ফুল এখন শুধু আর শৌখিন পণ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বাণিজ্যিকভাবে এর প্রসার ঘটেছে সব ক্ষেত্রে। মুনাফা ভালো পাওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ের চাষিরা ঝুঁকছেন ফুল উৎপাদনে। দেশের নানা প্রান্তে গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, ডালিয়া, জারবেরা, রজনীগন্ধা, জিপসি, গ্লাডিওলাস উৎপাদন হলেও এসব ফুলের পাশাপাশি দেশের গোলাপ ব্যবসার প্রায় অর্ধেকটাই জোগান দেয় সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাহপুরের গোলাপ গ্রাম। তুরাগ নদের পাড়ে গ্রামটির প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এর সঙ্গে। গোলাপের নয়নাভিরাম দৃশ্য ও মনোমুগ্ধকর সুবাস গ্রাস করবে যে কোনো ভ্রমণপিপাসুকে। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসে গোলাপের এই অনিন্দ্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এতে করে যেমন বেড়েছে বেচাকেনা তেমনি সৃষ্টি হয়েছে পর্যটন খাতেরও। এই সমারোহ স্বচক্ষে দেখতে নগরের ইটপাথরের যান্ত্রিক জীবন থেকে খানিক ছুটি নিয়ে একদিনের জন্য বেরিয়ে এলাম গোলাপের এই স্বর্গরাজ্য থেকে।

ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে গলা ভিজিয়ে শীতের সকালে উত্তরা থেকে ধউর বেড়িবাঁধ হয়ে পৌঁছে গেলাম আকরান বাজারে। বাজার থেকে অটোযোগে পিচঢালা পথ পেরিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছলাম গোলাপরাজ্যখ্যাত সাদুল্লাহপুর গ্রামে। গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে আঁকাবাঁকা সরু পথ। চোখ পড়ল পথের দু'ধারে বিস্তীর্ণ গোলাপের বাগান। ফুটে আছে টকটকে লাল গোলাপ। পুরো গ্রামজুড়েই ফুলের সৌরভ। সঙ্গে শীতের সকালের শিশির ভেজা গোলাপের পাপড়িতে নরম আলোর ঝিকিমিকি। সব মিলিয়ে মুগ্ধ হওয়ার মতো একটি জায়গা। শুধু সাদুল্লাহপুর নয় আশপাশের শ্যামপুর, কমলাপুর, বনগ্রাম, বাগ্মীবাড়ি গ্রামের গোলাপের রাজ্যে চোখ আটকে যাবে যে কারও। শুধু সৌরভ নয় সৌন্দর্য দিয়েই গোলাপ একটি গ্রামের নাম পাল্টে দিয়েছে। সাদুল্লাহপুরকে এখন পর্যটকরা গোলাপ গ্রাম হিসেবেই বেশি চেনেন।

গোলাপের জাত ও চাষ
লাল, হলুদ, সাদাসহ প্রায় সব ধরনের গোলাপের চাষ হলেও বাজারদর ভালো হওয়ায় মিরান্ডা জাতের গোলাপ এখানে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়। সাধারণত সারা বছর গোলাপ ফুটলেও ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস ফুলের ভরা মৌসুম। এ সময়ে আকারেও বেশ বড় হয় ফুলগুলো। বেলে দোআঁশ কিংবা এটেল দোআঁশ মাটি আর যত্নআত্তি পেলে গোলাপের গাছ বাড়ে বেশ দ্রুত। একেকটি গাছ কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত ফুল দিতে সক্ষম হয়।

জানা যায়, প্রায় বছর পঞ্চাশ আগে মানুষ এখানে গোলাপের চারা তৈরি ও চাষ শুরু করে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় নব্বই সালের প্রারম্ভে। শুরুতে আশানুরূপ সাফল্য না এলেও প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রাম বর্তমানে আলোর মুখ দেখছে। এখানকার মাঠে মাঠে শুধু রঙিন ফুলের সৌরভ নয়; আছে কৃষির বাণিজ্যিক অবকাঠামো, বহুমুখী লাভজনক উদ্যোগ। শাহবাগসহ রাজধানীর ফুলের বিভিন্ন বাজারে গোলাপের প্রধান জোগান দেন এখানকার চাষিরা। ফুলের এই রাজ্য বিভিন্ন বয়সী মানুষের কাছে অনন্য এক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

গোলাপের হাট
স্থানীয় চাষিরা নিজেদের প্রয়োজনেই বছর দশেক আগে এই গ্রামে গড়ে তুলেছেন হাট। সারাদিন পরিচর্যার পর গ্রামের প্রায় ২৫০ হেক্টর জমির চাষিরা সন্ধ্যার দিকে হাটে আসেন ফুল বিক্রি করতে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমতে থাকে হাট। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। মোস্তাবাজার ও কাশেমবাজার নামে দুটি হাট রয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা ভিড় জমায় ঐতিহ্যবাহী এই হাটে। ঘুরতে ঘুরতে স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, মৌসুমের সময় জাতভেদে প্রতি পিস গোলাপ ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হয় আর ৩০০ পিসের একেকটি আঁটি তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার টাকায়। অফ সিজনে দুই থেকে তিন টাকা পাইকারি দরে নেমে আসে প্রতি পিস। দৈনিক ৯ থেকে ১০ লাখ টাকাসহ সিজনে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার গোলাপ কেনাবেচা হয় এই হাটে। সব সময়ই গোলাপের চাহিদা থাকায় চাষিরাও সারা বছরই ব্যস্ত সময় কাটান। বিশেষ করে উৎসবের দিনগুলোতে চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। হাটে যাওয়ার পথে অসংখ্য ছোটবড় ফুলের দোকানের পসরার দেখা মিলবে, যেখান থেকে গোলাপপ্রেমীরা কিনতে পারবেন গোলাপ।

জমিদারবাড়ি
লোকচক্ষুর অন্তরালে সাদুল্লাহপুরের পাশেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরুলিয়া জমিদারবাড়ি। আকরান বাজার থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। গোলাপ গ্রামে একবেলা কাটিয়ে ঐতিহ্যের টানে চললাম সেখানে। গ্রামের শেষ মাথায় নদীর তীর ঘেঁষে বাড়িটি জমিদার রজনীকান্ত ঘোষের। সেখানে এখন বাস করছেন তার বংশধররা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে অনেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গেলেও বিরুলিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জমিদারবাড়ি লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। পুরোনো বাড়ি আর মাটির সোঁদা গন্ধ ফিরিয়ে নিয়ে গেল আমাদের ইতিহাসের সোনালি পাতায়। সেকালের জমিদার নলিনী মোহন সাহার কাছ থেকে রজনীকান্ত ঘোষ আট হাজার ৯৬০ টাকা চার আনি দিয়ে বাড়িটি কেনেন। বাড়িতে সদরঘর, বিশ্রামঘর, বিচারঘর, পেয়াদাঘর, ঘোড়াশালাসহ উল্লেখযোগ্য আরও কিছু ঘর রয়েছে। তবে এসব এখন অন্য কাজে ব্যবহার হচ্ছে।

যেভাবে যাবেন
মিরপুর হয়ে দিয়াবাড়ি বটতলা ঘাট থেকে নৌকায় বা আবদুল্লাহপুর-উত্তরা থেকে ধউর বেড়িবাঁধ হয়ে সিএনজি বা লোকাল বাসে বিরুলিয়া ব্রিজে যেতে হবে প্রথমে। ব্রিজে নেমে অটো বা লেগুনায় আকরান বাজারে নেমে রিকশা বা অটোতে সাদুল্লাহপুর গ্রামে যাওয়া যাবে। নিজস্ব পরিবহনেও এই পথ দিয়ে যাওয়া যাবে। সাভারের চৌরঙ্গী মার্কেট থেকে গোলাপ গ্রামের উদ্দেশে অটো চলে হরহামেশাই। চাইলে এ পথেও যেতে পারেন।

জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকিতে সুন্দরবন
কলম্বোয় নতুন দুবাই বানাচ্ছে চীন

আপনার মতামত লিখুন