বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঘুরে আসি

ঘুরে আসুন মহাশূন্য

অনলাইন ডেস্ক
২৭ আগস্ট ২০২২

মহাকাশ নিয়ে পৃথিবীবাসীর আগ্রহ আর বিস্ময়ের জায়গাটা সুপ্রাচীন। কৌতূহলী মানুষ তার জানার অদম্য ইচ্ছাকে পুঁজি করে পাড়ি জমিয়েছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে অসীম মহাশূন্যে। এতদিন সবটা শুধু গবেষণার খাতিরে হলেও, বর্তমান সময়ে এসে মানুষ ভাবছে মহাকাশ পর্যটনের কথা। হালের সুপরিচিত এই 'স্পেস ট্যুরিজম' নিয়ে লিখেছেন শাহরিয়ার জাওয়াদ

ভাবুন, মহাশূন্যে বেড়াতে যাচ্ছে মানুষ। প্রিয়জনদের নিয়ে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে পৃথিবীর চারপাশে আবর্তনরত কোনো স্পেস স্টেশনে। পর্যটকদের চাহিদার জোগান দিতে বিভিন্ন স্পেস ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে বিশেষায়িত হোটেল-মোটেল, শপিংমল, বিনোদন কেন্দ্র- যার সবই মহাশূন্যে, অসংখ্য স্পেস স্টেশনের ভেতরে।

বহুদূর থেকে একদল শিশু-কিশোরের কৌতূহলী চোখ তাকিয়ে আছে নিচে, চিরচেনা নীলরঙা গ্রহের দিকে। যেখানে আছে তাদের ঘরবাড়ি, স্কুল। যেখান থেকে তারা বেড়াতে এসেছে মহাশূন্যে, গ্রহটাকে ঘিরে থাকা কোনো অদৃশ্য কক্ষপথে।

কল্পবৈজ্ঞানিক গল্প-উপন্যাসে এমন কিছু হরহামেশা পড়লেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ভাবনা বাস্তবায়ন হওয়ার খুব দূরে নেই আমরা। অদূরভবিষ্যতে এমন কল্পনা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রকট। এই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে স্পেস ট্যুরিজম, যার বাংলা পরিভাষা হয় মোটামুটিভাবে- মহাকাশ পর্যটন।

প্রথমেই বোঝা যাক পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে কতটা উচ্চতায় আছে মহাকাশ। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) আর নাসার ভাষ্যমতে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০ মাইলের বেশি উচ্চতাকে মহাকাশ বলে বিবেচনা করা যায়। তবে এ নিয়ে মতপার্থক্য আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মহাকাশে পৌঁছতে হলে একজন নভোচারীকে পাড়ি দিতে হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ৬০ মাইল দূরত্বের উচ্চতা। সম্পূর্ণভাবে পেরিয়ে গিয়ে হবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কল্পিত শেষ সীমা- কারমান লাইন। তবেই নভোচারী পৌঁছে যাবেন মহাকাশে।

অজানাকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে মানুষ জয় করেছে জল, জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, অন্তরিক্ষ। ছুটে গেছে ঊষর মরু থেকে বরফ শীতল মেরু অঞ্চলে। দেখেছে পৃথিবীর অদেখা রূপ, জেনেছে এই জগতের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য সত্য। আবিস্কারের নেশায় ছুটে চলা মানুষ এখন ভাবছে মঙ্গলে বসতি স্থাপনের কথা। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের চোখে দেখছে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে আলো ছড়াতে থাকা অগণিত নক্ষত্রপুঞ্জ, আদিম গ্যালাক্সিগুলোকে।

এখন মানুষ ভাবছে বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণের কথা।


সেই ভাবনা থেকেই গড়ে উঠেছে স্পেস এক্স, ব্লু অরিজিন আর ভার্জিন গ্যালাক্টিকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২১ সালের ১১ জুলাই ভার্জিন গ্যালাক্টিকের প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন দু'জন পাইলট ও তাঁরই প্রতিষ্ঠানের তিন সহকর্মী- বেথ মসেস, কলিন বেনেট ও শ্রীসা বান্ডলাকে নিয়ে যাত্রা করেন মহাকাশের পথে। টেক্সাসের স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় নভোচারীদের নিয়ে উড়াল দেয় মহাকাশযান 'ভিএসএস ইউনিটি'। এক ঘণ্টার মহাকাশ ভ্রমণে ব্র্যানসন পৌঁছে যান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৩ মাইল উচ্চতায়। একই সঙ্গে মহাকাশে বাণিজ্যিকভাবে ভ্রমণকারী প্রথম ধনকুবের হিসেবে নাম লেখান ব্র্যানসন।

এই ঘটনার ঠিক ৯ দিন পর, ২০২১ সালের ২০ জুলাই অ্যাপোলো ১১ মহাকাশযানের ৫২তম চন্দ্র বিজয়বার্ষিকী উপলক্ষে বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণ করেন অ্যামাজনের সিইও ও ব্লু অরিজিনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। নিজ প্রতিষ্ঠানের 'নিউ শেপার্ড-৪' মহাকাশযানে চেপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬১ মাইল উচ্চতায় ভ্রমণ করেন বেজোস। তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ভাই মার্ক বেজোস, নারী মহাকাশচারী ওয়ালি ফাঙ্ক ও তরুণ অলিভার ডিমেন। জেফের সঙ্গে মহাকাশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিটি টিকিটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৮ মিলিয়ন ডলার।

যদিও বেজোসের পক্ষ থেকেই প্রথমে এসেছিল বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণের বার্তা। তারপর ব্র্যানসন খানিকটা তড়িঘড়ি করে যেন নিজের বাণিজ্যিক মহাকাশ যাত্রার কথা জানান এবং বেজোসকে টক্কর দিতে আগেভাগে উড়ে যান মহাকাশে। স্পেস এক্সের কোনো নভোযান এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ইলন মাস্ককে নিয়ে মহাকাশে ছুটে যায়নি। তবে ২০২০ সালে স্পেস এক্সের মহাকাশযান নাসার দুই নভোচারীকে নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে। সাধারণ যাত্রীর জন্য টিকিটের দাম প্রকাশ করেছে স্পেস এক্স; হালনাগাদের প্রক্রিয়াও চলমান। প্রতিষ্ঠানটির কোনো মহাকাশযানে চড়ে মহাকাশ ভ্রমণ করতে চাইলে আগ্রহী ব্যক্তিকে একটি টিকিটের জন্য গুনতে হবে ১০ মিলিয়ন ডলার।

ইলন যে পরিকল্পনামাফিক ধীরেসুস্থে স্পেস এক্স নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, সেটা অনুমান করতে বোধকরি খুব একটা বেগ পেতে হয় না। যেসব প্রতিষ্ঠান মহাকাশ পর্যটনকে সহজ করতে চাইছে সাধারণ মানুষের কাছে, দুই ধরনের মহাকাশ ভ্রমণের টিকিট বুকিং করার সুযোগ দিচ্ছে তারা- অরবিটাল স্পেস ট্রাভেল আর সাব-অরবিটাল স্পেস ট্রাভেল। যখন কোনো মহাকাশযান পর্যাপ্ত গতিতে কোনো অদৃশ্য কক্ষপথ ধরে পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তন করতে থাকে, তখন তাকে বলা হয় অরবিটাল স্পেস ট্রাভেল। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন এই ধরনের স্পেস ট্রাভেলের বেশ ভালো একটা উদাহরণ।


আবার যখন কোনো মহাকাশযান অরবিটাল স্পেস ট্রাভেলের তুলনায় কম গতি নিয়ে মহাকাশে ছুটে যায়, একটা নির্দিষ্ট সময় সেখানে অবস্থানের পর যাত্রীদের নিয়ে আবার ফিরে আসে পৃথিবীর বুকে- এমন স্বল্প সময়ের মহাকাশ ভ্রমণকে সাব-অরবিটাল স্পেস ট্রাভেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেফ বেজোস কিংবা রিচার্ড ব্র্যানসন দু'জনেরই মহাকাশ ভ্রমণের ধরন ছিল সাব-অরবিটাল। বর্তমানে কোম্পানিগুলো এই সাব-অরবিটাল স্পেস ট্রাভেল নিয়েই তুলনামূলক বেশি কাজ করছে। কেউ যদি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাকাশে ছুটে যাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহসী না হন কিংবা প্রস্তুত না থাকেন, সে ক্ষেত্রে 'জিরো জি'র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি জিরো গ্র্যাভিটির অভিজ্ঞতা আগ্রহী ব্যক্তিকে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতি সিটের জন্য খরচ হবে ৮ হাজার ২০০ ডলার।

বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণ অসংখ্য দক্ষ মানুষের চাকরির ক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই নতুন ধরনের পর্যটন খাতের সম্ভাবনা উদ্যোক্তাদের মনে উৎসাহ জোগাবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের। সেই সঙ্গে নতুনভাবে গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গবেষকের জন্য।

সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো, সাধারণ মানুষ বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের পর ছুটে যেতে পারবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে। কারমান লাইন পেরিয়ে তারা অভিজ্ঞতা লাভ করবে জিরো গ্র্যাভিটিতে ঘুরে বেড়ানোর। মহাকাশ থেকে বিস্ময়াভিভূত চোখে দেখবে এই নীল পৃথিবীর বক্রতাকে; বাড়বে তাদের চিন্তা ও কল্পনার পরিধি।

মহাকাশ পর্যটন মানবজাতির সামনে এক নতুন অভিজ্ঞতার হাতছানি। যেখানে অসীম মহাশূন্য হবে সীমানা। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না- প্রদীপের আলোর নিচেই থাকে অন্ধকার। এটা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি পরিবেশের জন্যও শঙ্কার কারণ রয়েছে।

গবেষণা বলছে, এক হাজার ব্যক্তিগত সাব-অরবিটাল ফ্লাইট এক বছরে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করবে, সেটি পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেবে অন্তত এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই সঙ্গে এই বর্ধিত তাপমাত্রার কারণে প্রতি বছর মেরু অঞ্চলের প্রায় ৫ শতাংশ বরফ গলবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব ত্বরান্বিত হবে। বিজ্ঞানীরা এখন কীভাবে মহাকাশযানের নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করছেন। এর ক্ষতিকর প্রভাব ও খরচ কমিয়ে আনতে পারলে মহাকাশ পর্যটন বদলে দিতে পারে পুরো বিশ্বের ভবিষ্যৎ।

কুয়াকাটা সৈকত এখন পর্যটকদের আতঙ্ক
একদিনের শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে ঘুরে দেখবেন যেসব স্পট

আপনার মতামত লিখুন