শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সীমানার ওপারে

অষ্টম মহাদেশ

রহস্যঘেরা জিলান্ডিয়া

আব্দুর রাজ্জাক
২৮ ডিসেম্বর ২০২১
অষ্টম মহাদেশ জিলান্ডিয়ার অংশবিশেষ- সংগৃহীত

অষ্টম মহাদেশ জিলান্ডিয়ার অংশবিশেষ- সংগৃহীত

সময়টা ১৬৪২ সাল। নেদারল্যান্ডসের নাগরিক আবেল তাসমান অজানার খোঁজে একটি দুঃসাহসিক মিশনের পরিকল্পনা করেন। সুসজ্জিত দড়ির মতো লম্বা গোঁফ ও দাড়ির এই ডাচ সেইলর সমুদ্রযাত্রায় তার সঞ্চিত দীর্ঘ অভিজ্ঞতার যেন পরীক্ষা নিতে চাইছেন। তার দৃঢ়বিশ্বাস; দক্ষিণ গোলার্ধে বিশাল এক ভূমির অস্তিত্ব আছে, যা সুদূরে বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। একরকম জেদ ধরে বসলেন, এটি তিনি খুঁজে বের করবেনই। যাত্রা শুরু করলেন দক্ষিণ প্রান্তের রহস্য উন্মোচনে। অনেকটা কয়েকজন নাবিক নিয়ে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ার মতো। এর পর থেকে কয়েক প্রজন্ম অতীত হয়ে গেছে; কিন্তু ঘোচেনি জিলান্ডিয়া নামের সেই বিশাল ভূমি বা অষ্টম মহাদেশের আসল রহস্য। আজও জানা যায়নি- কীভাবে সেটা গঠিত হয়েছিল, সেখানে কারা বাস করত আর কবে এটি দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।

সে সময় ইউরোপীয়রা মনে করতেন, উত্তরে তাদের মহাদেশের সঙ্গে পৃথিবীর ভূমিভাগের ভারসাম্য বজায় থাকতে দক্ষিণেও টেরা অস্ট্রেলিয়া নামের একটি মহাদেশ থাকা উচিত। কিন্তু সেটা কোথায় আর কী অবস্থায় আছে, তা নিশ্চিত ছিল না কেউই। তাই যেন খুঁজতে বেরিয়েছেন তাসমান। ওই বছরের ১৪ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে যাত্রা করল তার দল। ছোট ছোট দুটি জাহাজ নিয়ে প্রথমে পশ্চিমে গেল, পরে দক্ষিণে এবং দক্ষিণের দ্বীপ নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ঠেকল। সেখানে তাদের নোঙর করাটা সুখকর ছিল না। প্রথম বাধাটা এলো স্থানীয় আদিবাসী মাওরিদের থেকে। তারা তাসমানের নাবিকদের গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌকায় হামলা চালায়। এতে চার ইউরোপিয়ান মারা যান। পরে কামানের গোলা ছুড়লে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ক্ষোভের বশে ওই জায়গার নাম 'মার্ডারার্স বে' রেখে বাড়ি ফিরে আসেন নাবিকরা। সে যাত্রায় নিউজিল্যান্ড আবিস্কার হলো ঠিকই কিন্তু সূত্রপাত হলো নতুন রহস্যের। অস্ট্রেলিয়া আগে থেকে পরিচিত থাকলেও নিউজিল্যান্ডের পাশে আরেক বিশাল এক ভূমি আঁচ করেছেন বলে তাসমান দাবি করলেন। এতে ইউরোপীয়রা ধারণা করলেন, সেখানে আসলেই একটি মহাদেশের মতো ভূমি আছে, যা অস্ট্রেলিয়া নয়। এবার তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হলো এবং 'মার্ডারার্স বে'-এর নাম রাখা হলো টেরা অস্ট্রেলিয়া। পরে এর নাম দেওয়া হয় জিলান্ডিয়া। অনুসন্ধান এখানে থেমে থাকল না। এর এক শতাব্দীরও বেশি সময় পর ব্রিটিশ ম্যাপ প্রস্তুতকারী জেমস কুককে পাঠানো হয় দক্ষিণের সেই লুকায়িত ভূমির সন্ধানে। তিনিও গিয়ে ঠেকেন নিউজিল্যান্ডে। ফিরে এসে কুক জানান, তিনি নিউজিল্যান্ড পৌঁছার আগে ওই বিশাল ভূমির ওপর দিয়ে গেছেন।

জিলান্ডিয়ার অস্তিত্বের অনেকটা বাস্তব প্রমাণ এলো ১৮৯৫ সালে। সে সময় নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণের দ্বীপগুলোর জরিপ করতে যান স্কটিশ ন্যাচারালিস্ট জেমস হেক্টর। ফিরে এসে তিনি দাবি করেন- নিউজিল্যান্ড একটি পর্বতমালার অংশ, যা একটি মহাদেশীয় অঞ্চলের উপরিভাগ। অঞ্চলটি দক্ষিণ ও পূর্বের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। তবে তা নিমজ্জিত অবস্থায় আছে। তার পরও ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই তত্ত্ব অস্পষ্টই থেকে যায় বলে মন্তব্য করেন জিলান্ডিয়া নিয়ে ২০১৭ সালের এক গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী নিউজিল্যান্ডের ভূমিবিজ্ঞানী নিক মরটিমার। কেননা মহাদেশের সংজ্ঞা নিয়ে ভূমিবিজ্ঞানীরা একমত হন গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। বলা হলো- কোনো বিশাল ভূমিতে উঁচু উঁচু টিলা, বিভিন্ন ধরনের শিলা থাকলে এবং এর ভূত্বক অনেক মোটা হলে একে মহাদেশ বলা যাবে। এই সংজ্ঞা জিলান্ডিয়াকে মহাদেশ প্রমাণে এক রকম পরীক্ষায় ফেলে দিল। এবার অনেক প্রমাণ প্রয়োজন, যা তখন পর্যন্ত কেউ সংগ্রহ করেনি।

মিশন প্রায় স্থগিত হয়ে গেল। পরে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ববিদ ব্রুস লায়েন্ডিক আরও একবার ওই এলাকাকে একটি মহাদেশ দাবি করেন। তিনি বললেন, একে জিলান্ডিয়া বলা যেতে পারে। কিন্তু তখনও স্বীকৃতির জন্য বিস্তর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলো। এই বিতর্ক আরও ঘনীভূত হলো এর কিছুদিন পর যখন জাতিসংঘ সমুদ্রসীমার ওপর সংশ্নিষ্ট দেশগুলোর অধিকার বণ্টন করতে গেল। সব দেশের জন্য পার্শ্ববর্তী পানীর ৩৭০ কিলোমিটারের ওপর কর্তৃত্ব দেওয়া হলেও নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে বলা হলো- দেশটি যদি প্রমাণ করতে পারে, তারা জিলান্ডিয়া নামের কোনো মহাদেশের অংশ তবে তারা এর ছয় গুণ পানিসীমার ওপর বৈধ কর্তৃত্ব পাবে।

এবার এই বিতর্কের ইতি টানতে সাহায্য নেওয়া হলো স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের। স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্নেষণে আবিস্কার হলো অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় ভূমি জিলান্ডিয়া। তবুও বিতর্ক চলতে থাকল। ২০১৭ সালে আরেকবার খবরের শিরোনাম হয় জিলান্ডিয়া। এক দল ভূমিবিজ্ঞানী দাবি করলেন, ওই এলাকায় ৪৯ লাখ বর্গকিলোমিটারের একটি ভূখণ্ড আছে, যা মাদাগাস্কারের চেয়ে অন্তত ছয় গুণ। এতে বাগড়া দিল এনসাইক্লোপিডিয়া, ম্যাপ ও সার্চ ইঞ্জিনগুলোর কর্তৃপক্ষ। তারা বলল- মহাদেশ সাতটিই। ভূমিবিজ্ঞানীরা বললেন, এই তথ্য ভুল। পৃথিবীতে অষ্টম মহাদেশ আছে; যা ছোট, পাতলা ও তরুণ। এটি বেশ কিছু দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত, যার একটি নিউজিল্যান্ড। তবে এর ৯৪ শতাংশই এখনও প্রায় দুই কিলোমিটার পানির নিচে। এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন নিউজিল্যান্ডের ক্রাউন রিসার্চ ইনস্টিটিউট জিএনএস সায়েন্সের ভূমিবিজ্ঞানী অ্যান্ডি টুলোচ। তিনি বলেন, একটি চিরন্তন সত্য বিষয় আবিস্কার হতে কিছুটা সময় লাগে, জিলান্ডিয়াকে তার উদাহরণ বলা যেতে পারে।

রহস্যময় বিস্তৃতি : ৪০ কিলোমিটার পুরু ভূত্বকবিশিষ্ট জিলান্ডিয়ার অস্তিত্ব স্বীকৃত হওয়ার পর গবেষণা শুরু হয় এর সৃষ্টি নিয়ে। ভূমিবিজ্ঞানীদের দাবি- দক্ষিণ গোলার্ধের ভূমির সমন্বয়ে সুপার-কন্টিনেন্ট গন্ডোয়ানা গঠিত হয়েছিল প্রায় ৫৫ কোটি বছর আগে। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার অর্ধেক ও অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চল। ওই মহাদেশের অন্যতম অংশ ছিল জিলান্ডিয়া, যা সাড়ে ১০ কোটি বছর আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে কীভাবে আর কেন ওই অংশ গন্ডোয়ানা থেকে আলাদা হয়ে গেছে তা আজও রহস্য।

ভ্রমণ সাহিত্যে সংশপ্তক পদক পেলেন উদয় হাকিম
থার্টিফাস্ট নাইটে পর্যটক বরণে প্রস্তুত কুয়াকাটা

আপনার মতামত লিখুন