বাইক চালিয়ে পুরো দেশ ভ্রমণ

ভ্রমণ তাঁর নেশা, দেশকেও ভালোবাসেন মনেপ্রাণে। দেশের প্রতি এই ভালোবাসা আর জীবনের মানে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন বাংলাদেশ ভ্রমণে। একে একে ঘুরে বেড়ান অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের সব জেলা।
বলছিলাম ভ্রমণপিয়াসী রিফাত জাহান শাওনের কথা। সম্প্রতি দেশের ৬৪টি জেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিফাত জাহান শাওন। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তাঁর ভ্রমণের সূচনা।
যাত্রাপথে তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডারও বহুগুণ ভারী হয়েছে। পরিশ্রম, মেধা আর তীব্র মনোবল নিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রত্যেকটি অঞ্চলের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে। দেখেছেন তাদের জীবনযাত্রা, জানার চেষ্টা করেছেন তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধসহ আঞ্চলিক ভাষা ও খাদ্যাভাস নিয়ে। শাওন মনে করেন, পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের অর্জিত জ্ঞান আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
শাওনের ভ্রমণের শুরুটা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি নেত্রকোণার বিরিশিরি ভ্রমণের মাধ্যমে। সেখান থেকে ফিরে এসেই তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, জীবনটা অনেক বেশি সুন্দর। এরপর তিনি প্রায় ৪৮টি জেলা ভ্রমণ করেন। তবে ২ মার্চ ২০২০ করোনা পরিস্থিতির কারণে তিনি ভ্রমণ থেকে অব্যাহতি নেন, তবে লকডাউন শেষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মোটরবাইকে শুরু হয় তাঁর ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব। প্রায় ৬০০০ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে বাকি ২৬টি জেলা ঘুরেন তিনি।
মোটরবাইকে চষে বেড়িয়েছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। বাইকের এই অদ্ভুত সুন্দর যাত্রায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বন্ধু সোয়েব আহাম্মেদ সাজিব। যার দক্ষ ড্রাইভিংয়ের জন্য সুস্থভাবে বাড়ি ফিরতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
শাওন তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘‘হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর এই সমৃদ্ধ বাংলাকে জানতে হলে ভ্রমণের বিকল্প নেই। প্রযুক্তির এই যুগে আমরা যেন ঘর থেকে বেরোতেই চাই না। কিন্তু সময় এখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছুটে চলার। বাঙালি জাতি হিসেবে যদি নিজের দেশ ও জাতিসত্বা সম্পর্কে না জানি, তবে বাংলার এ হাজার বছরের ইতিহাস একদিন বিলীন হয়ে যাবে, যেভাবে বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শত শত নদী, যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি।
বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে যে নদীগুলো একসময় প্রবাহমান স্রোতে পাল তোলা নৌকা ভেঁসে বেড়াত, সেই নদীতে আজ পানি নেই। নদীর মধ্যখানে হয় ইটের ভাটা। দেখা যায় না ধান ক্ষেত। ইতিহাস ঐতিহ্যেরও অবক্ষয় কিন্তু কম হচ্ছে না। মোঘল ও সুলতানি আমলের কারুকার্য খচিত অনেক মসজিদ ও স্থাপত্ব আজ অযত্নে পড়ে আছে, নতুবা সেই কারুকার্যের উপর বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে চকচকে টাইলস। এভাবে চলতে থাকলে হাজার বছরের এই স্থাপত্য টিকে থাকবে কী করে?’’
দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণের শেষ জেলা ছিল বরগুনা। ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ বরগুণা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তাঁর বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষ হলেও ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভ্রমণের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটেয়েছেন। তাঁর এই প্রাপ্তি উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সব শহীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
রিফাত জাহান শাওনের বয়স ১৯ বছর ৯ মাস ২৩ দিন, তাঁর মতে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সী ট্রাভেলার, যিনি পুরো বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। সম্পূর্ণ যাত্রায় তাঁর সময় লেগেছে ১ বছর ১১ মাস।
তিনি আরও বলেন, ‘আজ বিজয়ের ৪৯ বছরে এটিই আমার বিজয়। আমার বাবা-মা আমার সব থেকে বড় অনুপ্রেরণার উৎস।’
এ যাবত তাঁর ভ্রমণের সব ব্যয়ভার তার পরিবার বহন করেছেন। তবে বাংলাদেশের সব জায়গাতেই বন্ধু ও শোভাকাঙ্ক্ষী থাকার হেতু তার ভ্রমণ আরও সুন্দর ও সহজলভ্য হয়েছে। শাওন বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত রয়েছেন।
তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি দেশ ভ্রমণ করার ইচ্ছে। তাই সর্বপ্রথম নিজের মাতৃভূমির প্রতিটি জেলা বিচরণ করে বিশ্বভ্রমণের জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি।’
শাওন মনে করেন, পুরোপৃথিবী ঘুরার আগে নিজ দেশের পুরোটা দেখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মতামত লিখুন