শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

করোনা থেকে শিক্ষা

মুহাঃ আবদুর রব
২০ জুন ২০২০

সীমাহীন আকাশের মালিক, তামাম জাহানের শ্রষ্ঠা ও মালিক, দৃষ্টিনন্দন এ সুন্দর পৃথিবীর মালিক, সমগ্র-সৃষ্টি কূলের জান ও মালের মালিক, পৃথিবীর বুকে দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন ক্ষমতা চালাবার ক্ষমতাধর শাসকদেরও শাসক, সকল জাতের সৃষ্টির আহারদাতা সেই মহান রাজ্জাক- কেন আজ বিশ্ববাসীর উপর করোনা নামক অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস পাঠিয়ে বিশ্ববাসীকে নাড়িয়ে দিলেন! তা কি আমরা গভীর অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে ভেবে দেখেছি? আজ সময় এসেছে গভীরভাবে চিন্তা করার; এমানুষগুলো তাঁর এতো মহব্বতের সৃষ্টি, যাদের জন্য এ পৃথিবীটাকে এত সুন্দর সাজে সাজিয়েছেন; মানুষের সবার জন্যই; বানিয়েছেন নদ-নদী, সাগর-গিরি, পাহাড়-পর্বত, গাছ-গাছালী, পশু-পাখী, হাওর-জংগল, ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল ধরণের প্রাণীকূল; মাটির নীচেও গ্রোথিত রেখেছেন সোনা-দানা, গ্যাস-তেল, হীরা-জহরত, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, নীহারিকা-চায়াপথ, এ সবকিছুই তার নিপূণ হাতের তৈরি। সকল সৃষ্টিকে আল্লাহ তার কর্মকাণ্ডের অধীন করেছেন বাধ্যতামূলকভাবে। তাই চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র পারেনা তার কক্ষপথ পরিবর্তন করেত। পাহাড়-পর্বত পারেনা তার স্থান পাল্টাতে। অর্থাৎ কোনো সৃষ্টিই পারেনা তার নির্ধারিত গণ্ডি অতিক্রম করে কিছু একটা করতে। কেবল সৃষ্টির সেরা মানুষগুলোই তার ব্যতিক্রম। মানব জাতিকে আল্লাহ দুটি বিষয়ে স্বাধীনতা দিয়েছেন-

(১) চিন্তা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা;

(২) কর্ম-প্রচেষ্টার স্বাধীনতা।

এটুকু স্বাধীনতা পেয়ে মানুষ গোটা বিশ্বটাকে তার মত করে সাজাতে এবং ভোগ ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। ফলে মূল সৃষ্টি যার তাঁকে ভুলে নিজেকেই স্রষ্টার আসনে সমাসীন করতে চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে তারা ধরাকে সরাজ্ঞান করে নিজকে তাগুতে পরিনত করে বসে। এমন কি মানবজাতির জন্য আল্লাহর দেয়া কর্মপরিকল্পনা কে উপেক্ষা করে নিজেরাই নিত্য নতুন পথ ও পন্থা তৈরি করতে থাকে।

উল্লেখিত দুটো ক্ষুদ্র বিষয় ছাড়া আর কোনো কিছুরই অবাধ স্বাধীনতা আল্লাহ মানুষকে দেন নি। যার ফলে তারা হাজারো চেষ্টা করেও একটা ক্ষুদ্র কীট-পতঙ্গ, মশা-মাছিও তেরী করতে পারেনা। হাজারো চেষ্টা করেও বৃষ্টিহীন আকাশ থেকে এক ফোটা বৃষ্টির পানি ফেলতে বীর-মহাবীরগণ সক্ষম হন না। পারেনা আইলা, সিডর, ফণী নামাক ঘূর্ণিঝড়ের গতি পাল্টিয়ে দিতে। শত চেষ্টা-প্রচেষ্টার পরও পারেনি রাতকে দিন এরং দিনকে রাতে পরিণত করতে। এমনকি নিজে দেহের ক্ষুদ্র একটি  অঙ্গঁকেও তাঁর ইচ্ছার ব্যতিক্রম চালাতে পারে না। যেমন চোখের কাজ মুখ করে না। দুনিয়ার খোদা দাবি করে চিরস্থায়ী জীবন লাভ করতে পারেনি ফেরাউন, খোদার বাহিনীকে তীর মেরেও নিজকে রক্ষা করেত পারেনি নমরুদ; পাহাড় কেটে অট্টালিকা তৈরি করেও আত্মরক্ষা করতে পারেনি আদ ও সামূদ জাতি। বিশ্বজয়ী আলেকজাণ্ডার খালী হাতেই বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। কাজেই এক আল্লাহর প্রতি যাদের পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে আছে, যাঁরা মনে করে আল্লাহ এক ও একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। এ বিশ্বজাহান তাঁরই সুষ্ঠু পরিকল্পনায় পরিচালিত। নবী মোহাম্মদ (সঃ) তাঁরই পক্ষ থেকে মানবতার পথ-প্রদর্শক, মহগ্রন্থ আল কুরআনই হচ্ছে মানবজাতির জন্য হিদায়াতের পথ ও পন্থা, মানুষের জন্য এ দুনিয়ার জীবনটা অতীব ক্ষণস্থায়ী এবং প্রকট পরীক্ষাগার। আবার সকলকে মাবুদের কাছেই ফিরে যেতে হবে। তখন তার দুনিয়ার জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা হবে এবং তারই ভিত্তিতে চূড়ান্ত পর্যায়ের অবস্থান স্থল নির্ধারিত হবে। অতএব যতটুকু স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তাকে সঠিক পদ্ধতিতে কাজে লাগিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মানুষ পারে কিনা সেভাবে পথ চলতে তারই পরীক্ষা স্বরূপ মাঝে মাঝে আল্লাহর পক্ষ থেকে তা যাচাইয়ের জন্যই নেমে আসে নানাবিধ বিপদ-মুসিবত।

প্রসংগত- মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ২ নম্বর সূরা, সূরা আল-বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন-তরজুমা বা অনুবাদ- ‘‘নিশ্চয়ই আমি ভয়-ভীতি, দুর্ভিক্ষ, জান-মালরে ক্ষতির দ্বারা এবং উপার্জন ও আমদানী হ্রাস কর তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সব করবে তাদের জন্য রয়েছে সু-সংবাদ।’’

এ আয়াতের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় অতীব ক্ষুদ্র যা খালী চোখেতো দেখা দূরে থাক সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও ধরা পড়ে না সেই করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯; ভাইরাসটির ফলে সৃষ্ট রোগ) ভয়ে তামাম বিশ্বের সকল বৃহৎ শক্তি, আমেরিকার গ্রেট বৃটেন, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জাপান, জার্মান সহ সকলেই থর থর করে কাঁপছে। পাশাপাশি পঙ্গপালের অত্যাচারে ফসলহানীর ঘটনাও ঘটে চলছে; যার ফলে দুর্ভীক্ষ দেখা দেওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের জীবনাবসানে দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল যেন বেড়েই চলছে। দেশের ভেতরে নানা ধরণের যান চলাচল বন্ধ এমন কি বিমান চলাচল বন্ধের ফলে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। এরই প্রেক্ষিতে আন্ত আমদানি-রপ্তানিও সংকুচিত হয়ে এসেছে। স্বল্প আয়ের লোকদের দৈনন্দিনের কাজ না থাকায় অসহায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠি জীবন জীবাকার্জনে হীম-সীম খাচ্ছে। এতে করে এতে করে পরিষ্কার রূপে কুরআনের মাত্র এ একটি আয়াতে আল্লাহর দেয়া স্পষ্ট ধারণা আজ যেন দুনিয়ার মানুষের সামনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে মনে-দিলে-চোখে আঘাত করছে। মহান আল্লাহ আবার এ ভয়াবহ বিপদ মুসিবত থেকে উদ্ধারের উপায়ও বলে দিয়েছেন। এ আয়াতেরই শেষাংশে আল্লাহ বলেন, এমতাবস্থায় যারা সবর বা ধৈর্য ধারণ করে তাদের জন্য রয়েছে সু-সংবাদ। আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার পূর্বশর্ত তিনি বলেছেন ১৫৩ নম্বর আয়াতে- ‘‘হে ঈমানদারগণ! সবর ও নামাজের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো; আল্লাহ সবর কারীদের সাথে আছেন।’’

তাহলে সবর বা ধৈর্যের পূর্বশর্ত হলো- আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং খুশু-খুযুর সাথে সালাত আদায় করা।

আজ বিশ্বের আক্রান্ত দেশগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করলেও আমরা দেখতে পাই আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনা, কিতাবের প্রতি অনাস্থা, নামাজের প্রতি বিদ্ধেষ, ঈমানদারদের প্রতি নানাহ্ ধরণের জুলুম-অত্যাচার, নৈতিকতার চরম অবক্ষয় যেন এ ধরণের একটি পরীক্ষায় পড়তেছে মানবতা।

সুতরাং জালেম-মজলুম, স্বৈরাচার-নির্যাতীত, খোদাপন্থী-খোদাদ্রোহী সকলের তরেই আজা করোনাভাইরাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ফিরে আসতে হবে সত্য ও ন্যয়ের পথে। ঈমানকে দৃঢ় করে সালতে আন্তরিক হয়ে ফিরে আসতে হবে আল্লাহর দিকে। এ পর্যায়ে কয়েকটি পরামর্শ রাখতে চাই-

** দীনি দৃষ্টিকোন থেকে যেসব শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন-

১) আল্লাহ্ই একমাত্র এদুনিয়ার মালিক-মুনিব তা মেনে নিন।

২) মানুষগুলো আল্লাহর সেরা সৃষ্টি- কিন্তু আল্লাহর বান্দা ও খলিফা।

৩) মোহাম্মদ (স:) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল- আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।

৪) কুরআনই বর্তমানে একমাত্র পথ নির্দশিকা- তাতে বর্ণিত পথই সঠিক পথ।

৫) নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতে গাফলতি করা যাবে না।

৬) বেশি বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে প্রতিটি ক্ষণকে কাজে লাগাতে হবে।

৭) কুরআন, হাদিস ও ইসলামের ব্যাপক চর্চা বাড়াতে হবে। মা-বোনেরা পর্দায় থাকুন, চতরকে হিফাজত করুণ।

৮) একান্তে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিয়ে চোখের পানি ফেলে তাওবা, ইস্তেগফার করে সাহায্য কামনা করতে হবে।

৯) মিথ্যা, ধোকা, প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ ছেড়ে সত্যের উপর দৃঢ় হতে হবে।

১০) জীবনকে অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ভেবে, যে কোনো মুহুর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনা মনে রেখে প্রতিটি মুহুর্তকে আল্লাহর কাজে লাগাতে হবে।

** সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে করণীয়-

১) সতর্কতা অবলম্বনের স্বার্থে আপন ঘরের বাহিরে যাতায়াত না করাই উত্তম।

২) বাহিরে যেতে হলেও মাস্ক, গ্লাভ্স পরে অপরের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।

৩) অযু গোসল নিয়মিত করে সর্বদা পবিত্র থাকার চেষ্টা করুণ।

৪) কারও উপর জুলুম, অত্যাচার, অবিচার হওয়ার মত কোন কাজ পরিহার করুন।

৫) আমানতের খিয়ানত ও ওয়াদা খেলাপের মত কোন কাজে বা কথায় জড়াবেন না।

৬) নিজের কল্যাণের পাশাপাশি অপরের  কল্যাণকে আপনার কাজের অংশ বানান।

৭) প্রতিবেশীর প্রতি সদয় হউন, দরিদ্রদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ান; অসহায়ের দিকে সহায়তার নজর দিন।

৮) বৃদ্ধদেরকে সম্মান করুণ, শিশুদেরকে স্নেহ করুণ, রূগীর প্রতি সহানুভূতিশীল হউন।

৯) পিতা-মাতা-আত্মীয় স্বজনের হক আদায়ে আন্তরিক হউন।

১০) রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক নিয়ম কানুন মেনে চলুন।

১১) গুজব ছড়াবেন না, গুজবে কান দিবেন না।

১২) যুবক-যুবতীরা অসামাজিক কার্যক্রম চিরতরে বন্ধের জন্য তাওবা করুণ।

**পেশাজীবী, কর্মজীবী ও ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ-

১) যেখানেই থাকুন পেশার হক আদায় করুণ; সেবার মনোভাব নিয়ে স্ব-স্ব পেশার দায়িত্ব পালনে স্বচেষ্ট হউন।

২) কর্মহীন হলেও ধর্মহীন হবেন না। ধর্মপালনের মাধ্যমইে কর্মফল পাবেন।

৩) খাদ্যে ভেজাল মিশাবেন না; মাফে কম-বেশ করবেন না।

৪) পণ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম-সংকট সৃষ্টি করে জনগণকে কষ্ট দিবেন না।

৫) নারীদেরকে পণ্য সামগ্রীর প্রচার মাধ্যম বানাবেন না। পতিতালয় বন্ধ করুণ। অবাধ যৌনতার পথ রোধ করুণ।

৬) সম্পদশালীগণ এমুহুর্তে পারলে অসহায়দের জন্য সম্পদ কুরবানী করুণ।

৭) দীনের প্রবক্তাগণ মানুষকে দীনের সঠিক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করুণ।

৮) সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালকবৃন্দ কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে সমাজ ও দেশ পরিচালনা করুণ। বুঝের ঘাটতি থাকলে সমজদ্বারদের কাছ থেকে ধারণা নিন।

৯) কথা ও কাজে মিল রেখে মুসলিম চরিত্রের প্রকাশ ঘটান।

১০) অমুসলিম জনগণের নাগরিক অধিকার ও স্ব-স্ব ধর্মীয় অধিকার যেন পূর্ণ মাত্রায় ভোগ করতে পারে সে দিকে নজর দিতে হবে।

** আসুন সকলে মিলে মহান মালিকের কাছে কায়োমন বাক্যে দোয়া করি- "রাব্বি আন্নী মাগলূবুন ফান্তাসির" ‘‘হে আমাদের পরওয়ার দিগার! আমরা হেরে গেছি, অতএব আমাদেরকে সাহায্য করুণ।’’

লেখক : সাবেক উপাধক্ষ্য, ইবনে তাইমিয়া স্কুল এন্ড কলেজ, কুমিল্লা

বদলে যাচ্ছে পর্যটন গন্তব্য
আব্বা আমার স্বর্গ

আপনার মতামত লিখুন