মাতৃদুগ্ধ পানের সময়সীমা: ইসলামি দৃষ্টিকোণ

❓মাতৃদুগ্ধ পানের সময়কাল কত?
✅সাধারণত জন্ম থেকে দুই বছর পর্যন্ত। বা দুই বছরের কম।
❓সর্বোচ্চ সময়সীমা কত?
✅পূর্ণ দুই বছর। এই সময়টুকু পূর্ণ হলে শিশুকে অবশ্যই দুগ্ধপান ছাড়াতে হবে।
❓হুট করে তো ছাড়ানো যায় না! যদি একটু বেশি সময় লাগে?
✅এটা করা যাবে না। দুই বছরের সীমা লঙ্ঘন করা কুফরি, যা গুণাহে কবিরাহ।
❓হঠাৎ বন্ধ করলে মা-শিশু উভয়েরই তো সমস্যা হতে পারে!
✅এজন্য নির্দিষ্ট সময় আসার আগে থেকেই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করানোর চেষ্টা করতে হবে।
❓দুই বছর পূর্ণ হবার আগে মাঝে মাঝে বন্ধ রাখলে কি বাচ্চার অধিকার খর্ব হয়ে যায় না?
✅না, হয় না। বরং বিশেষ আবশ্যকতায় দুই বছরের আগেও দুধ ছাড়ানো যায়।
❓এই কথাগুলোর দলিল কী?
✅সূরা বাকারা, আয়াত: ২৩৩।
❓কিন্তু অনেক আলেম তো বলেন, দুই বছরের সীমা কেবল ছেলেদের জন্য; কন্যাশিশু নাকি আড়াই বছর পর্যন্ত দুধ পান করতে পারে?
✅কুরআন-সুন্নাহর বিপরীত কথা পরিত্যাজ্য; দলিলবিহীন কথা যারা বলেন, তারাও।
❓কুরআনেই তো দুধপানের সময়কাল আড়াই বছর উল্লেখ রয়েছে।
✅আড়াই বছর নয়, বরং বলা হয়েছে 'সালাসূনা শাহরা'। যার শাব্দিক অর্থ- 'ত্রিশ মাস।'
❓এই তো! ত্রিশ মাস মানেই তো আড়াই বছর। তাহলে দুধ পান করাতে সমস্যা কী?
✅সমস্যা আছে। কারণ এই ত্রিশ মাস কেবল দুধপানের জন্যই নির্দিষ্ট নয়, সেখানে বলা হয়েছে- 'ওয়া হামলুহু ওয়াফিস্বালুহু', গর্ভকাল+দুগ্ধপান ছাড়ানো'।
❓বুঝলাম না! গর্ভধারণ কাল তো নয় মাস। সেই হিসাবে দুধ পান কাল যদি দুই বছরই হয়, তাহলে মোট সময়কাল তেত্রিশ মাস। ত্রিশ মাসের হিসাব তো মিলছে না!
✅মিলবে না। কারণ গর্ভকাল তো নয় মাসে নির্দিষ্ট নয়, ক্ষেত্রবিশেষ কম-বেশি হয়। তবে সর্বনিম্ন গর্ভকাল 'ছয় মাস'।
❓ছয় মাস! এই কথার ভিত্তি কী?
✅সূরা আহযাব, ১৫ নম্বর আয়াত। এখানে বলা হয়েছে- "গর্ভধারণ ও স্তন্য ছাড়ানোর সময়সীমা ত্রিশ মাস"। আর এ নিয়েই দুধপানের বিষয়ে এতো বিতর্কের অবতারণা! অথচ আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ২৩৩ নম্বর আয়াতে দুধপানের সীমারেখা 'পূর্ণ দুই বছর' নির্দিষ্ট করেই দিয়েছেন। এ কারণেই আলী (রাঃ) সুরা আহকাফের এই আয়াতদৃষ্টে রায় প্রদান করেন যে- গর্ভকালের সর্বনিম্ন সময় ছয় মাস।
❓এ বিষয়ে ইজমা হয়েছে? কীভাবে?
✅উসমান (রাঃ) এর খেলাফতকালে জনৈকা মহিলার ছয় মাসে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে যায়। মহিলার স্বামী কাজির দরবারে বিচারপ্রার্থী হলে একে অবৈধ গর্ভ সাব্যস্ত করে শাস্তির আদেশ (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) জারি হয়। কেননা, এটা ছিল সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত ঘটনা। আলী(রাঃ) এই সংবাদ অবগত হয়ে উসমান(রাঃ) এর নিকট আসলেন এবং এই রায় কার্যকর করতে বারণ করলেন। তিনি আলোচ্য আয়াত (সুরা বাক্বারা এবং আহকাফ) দ্বারা প্রমাণ করে দিলেন যে, গর্ভধারণের সর্বনিম্ন সময়কাল ছয় মাস। খলিফা তার যুক্তিপ্ৰমাণ কবুল করে শাস্তির আদেশ রহিত করার হুকুম দিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই আদেশ পৌঁছার আগেই দন্ড কার্যকর হয়ে যায়। পরবর্তীতে মহিলার স্বামী ভূমিষ্ট হওয়া শিশুটিকে দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। কেননা, আল্লাহর ইচ্ছায় এই শিশুটির সাথে লোকটার সাদৃশ্য এতো বেশিই ছিলো যে, দুটো ডিম কিংবা দুটো কাকের মধ্যেও এতো নিখুঁত মিল হয় না। সুবহানাল্লাহ! সেই থেকেই ইমামগণ একমত যে, গর্ভধারণের সর্বনিম্ন সময়কাল ছয় মাস। [সূত্র: তাফসীরে ইবনে কাসির]। এছাড়াও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ছয়মাসের গর্ভকাল বিষয়টি পরীক্ষিতভাবেই প্রমাণিত।
❓তবে তো আরেকটা প্রশ্ন এসে গেল! যদি গর্ভকাল এবং দুধপানের সর্বমোট সময়সীমা ত্রিশ মাস হয়, তবে ন'মাস গর্ভধারণের পর জন্ম হলে সেই শিশুর দুধপানের সময় কি একুশ মাস হবে না?
✅ঠিক তাই! এই বিষয়েও তাফসীরে ইবনে কাসিরে বর্ণিত হয়েছে। সুরা আহকাফের উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- "কোন মহিলা ন'মাসে সন্তান প্রসব করলে সেই শিশুর দুধপান সময়কাল একুশ মাস, সাত মাসে প্রসব করলে দুধপানের সীমা তেইশ মাস। আর যখন ছয় মাস পর সন্তান জন্ম হয়, সেই শিশুই কেবল পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করবে।
❓দুই বছরের হিসেবও তো তাহলে নির্দিষ্ট না!
✅হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। আমাদের হিসাবে সচরাচর আরো একটা ভুল হয়ে যায়। আমরা সাধারণত সময় গণনা করি খ্রিস্ট বর্ষের ভিত্তিতে। অথচ ইসলামে বর্ষ মানেই কিন্তু চন্দ্রমাসের হিসাব। হিজরি সাল অনুযায়ী বছরে এগার দিন হিসেবে দু'বছরে খ্রিস্ট বর্ষে কমে যাচ্ছে বাইশ দিন, যা প্রায় একমাসের মতো। সুতরাং, দুধপানের স্বাভাবিক সীমা দুই বছরও যদি হিসেবে ধরা হয়, তাহলেও খ্রিস্ট বর্ষ অনুযায়ী তেইশ মাসেই দুধ ছাড়ানো উচিত।
❓বেশ জটিল হিসাব!
✅আশার কথাও রয়েছে। গর্ভকালের সাধারণ সীমা নয় মাস। কুরআন বলছে, গর্ভধারণের তিনমাস পর ভ্রূণে রূহ সঞ্চারিত হয়। এসময় মায়ের শরীর থেকে খাদ্য সরবরাহ শুরু হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের বক্তব্যও অনুরূপ। এখন, ত্রিশ মাস থেকে মাতৃগর্ভে খাদ্য গ্রহণকাল ছয় মাস বাদ দিলে অবশিষ্ট চব্বিশ মাস বা দুই বছর। আর এই দুই বছরকেই আল্লাহ তায়ালা শিশুর দুধপানের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
❓আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু দুই বছর পরে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোই যাবে না- এটার দলিল কী? এটা তো ইসলামের কোথাও বলা নেই!
✅ইসলামে নেই? আজিব! দুই বছর যদি না হয়, তবে সীমারেখাটা কত? স্কুলে যাওয়ার বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করবে?! ইসলাম তো 'পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।' ইসলামে যদি এটা বলা না-ই থাকে, তাহলে সেটা চালিয়ে যেতে চাইছি কিসের ভিত্তিতে? নাই জিনিসের দলিল-ই বা হয় কী করে?!
❓পূর্ণ দুই বছর বলা হয়েছে, দুইয়ের বেশিতে নিষেধাজ্ঞা তো নেই। তাহলে অসুবিধা কী?
✅অসুবিধা কী! আচ্ছা!!
একটা সুউচ্চ টাওয়ারে কিছু লোক আরোহণ করলো। এদেরকে ছাদের রেলিঙ দেখিয়ে বলা হলো, "এই সীমানার ভেতরে যত ইচ্ছে ছোটাছুটি করো।" আর কিছু বলা হয়নি। এখন কেউ যদি ভাবে- রেলিঙের বাহিরে যেতে নিষেধ করা হয়নি, গেলে অসুবিধা কী? এই 'অসুবিধা কী' মার্কা দলিলের ভিত্তিতে কেউ যদি পাঁচিল টপকে যায়, বা সীমানা অতিক্রম করে, তার পরিণতি কী হবে?
❓ভয়ঙ্কর! এটা নিঃসন্দেহে বোকামি।
✅তাহলে, যেখানে আল্লাহ তায়ালা নিজেই শিশুর দুধপানকে 'দুই বছর' নির্দিষ্ট করে 'সীমানা' টেনে দিয়েছেন, সেখানে কেউ যদি সীমারেখা অতিক্রম করতে যায়, তার পরিণাম কী হতে পারে?
❓অবশ্যই মারাত্মক। খুবই ভয়াবহ। কিন্তু এর সমাধান কী?
✅সমাধান তো সূরা বাক্বারার ২৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জানিয়েই দিয়েছেন-
"আর জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর স্তন্য পান করাবে; এটা সে ব্যক্তির জন্য, যে স্তন্যপান কাল পূর্ণ করতে চায়।..."
অতএব, এটা একেবারেই সুস্পষ্ট যে, স্তন্যদানের পূর্ণ সময়সীমা দু’বছর পর্যন্ত। অতএব, এই সময়সীমার পর শিশুকে স্তন্যপান করানো কুফরি, যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ।
[আল্লাহু আ'লামু বিল গাইব।]
✏লেখক : প্রভাষক, সোনাপুর কলেজ, নোয়াখালী।
আপনার মতামত লিখুন