শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ | ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

সোনাদিয়া ইকো পার্ক: পর্যটন সম্ভাবনা নাকি প্রতিবেশ ধ্বংস?

নাজিফা ফারহাত
৩১ মার্চ ২০২২

বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে একটি বড়সড় ইকো ট্যুরিজম এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দ্বীপের ৩১৫টি পরিবারের ১ হাজার ৭৬২ জনকে প্রথমে স্থানান্তর করতে হবে।

দ্বীপের বাসিন্দাদের মহেশখালী চ্যানেল পার হয়ে ঘটিভাঙ্গা নদীর তীরে কুতুবজোম ইউনিয়নে স্থানান্তরিত করা হবে বলে জানা গেছে। সরকার জোর দিয়ে বলেছে, এসব বাসিন্দাকে জীবিকা অর্জনের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। যদিও এতে আশ্বস্ত নয় দ্বীপবাসী।

গত ডিসেম্বরে পুনর্বাসনস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদক দেখেন, ইতোমধ্যে জমি প্রস্তুতের কাজ চলছে। বসানো হয়েছে বিদ্যুতের লাইনও।

বেপজার উপ-সচিব ও পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা পুনর্বাসন স্থানে সব ধরনের নাগরিক সুবিধার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করব। সোনাদিয়ার মানুষ পশ্চিম অঞ্চলে শুঁটকি মাছ চাষের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই পুনর্বাসন স্থানটিও মাছ ধরা যায় এমন এলাকায় করা হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “দ্বীপবাসীরা পুনর্বাসন স্থানে শুঁটকি মাছ উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারবে এবং সোনাদিয়া ইকো পার্কের কাজ শুরু হলে সেখানেও নির্মাণকাজের সুযোগ পাবে।”

“প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার পরেও স্থানীয়দের কাজের সুযোগ থাকবে, কারণ পার্কটিতে আসা দর্শনার্থীদের আতিথেয়তার জন্য কর্মীর প্রয়োজন হবে,” তিনি বলেন।

তবে, দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন, তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকারে। কারণ বেপজা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। অনেক দ্বীপবাসী তাদের আবাসস্থল ছেড়ে যেতে নারাজ কারণ বংশ পরম্পরায় তারা সেখানেই বসবাস করে আসছেন।

সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য একরাম মিয়া বলেন, “বেপজার লোকজন এখানে কী করতে যাচ্ছেন সে বিষয়ে আমাদের সঙ্গে একবারও যোগাযোগ করেননি। আমরা গরিব মানুষ, পুরো দ্বীপে কোনো হাসপাতাল নেই এবং সবচেয়ে কাছের স্কুলটিও তিন কিলোমিটার দূরে হওয়ায় দ্বীপের পূর্ব পাশের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার প্রয়োজনের সময় আমাদের সাহায্য করেনি। আর এখন তারা আমাদের দূরে ফেলে দিতে চায়।”

আরও সুযোগ-সুবিধা আছে এমন এলাকায় যেতে তারা ইচ্ছুক কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা উন্নয়ন চাই, এটা ঠিক। কিন্তু আমাদের জীবিকা ও সুস্থতা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, আমরা আমাদের জমি রক্ষা করার জন্য প্রতিবাদ করব এবং প্রয়োজনে জীবনও দেব।”

১৬.৯৫ বিলিয়ন টাকার প্রকল্পটির লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে পুরো দ্বীপটিকে দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের কেন্দ্রে পরিণত করা।

মহাপরিকল্পনা অনুসারে, দ্বীপের মাত্র ৩% পর্যটন কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করা হবে। তবে, বেপজা সোনাদিয়া দ্বীপের বাকি অংশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করারও পরিকল্পনা করেছে।

দাবি এবং পাল্টা দাবি

স্থানীয়দের দাবি, সরকার শুধুমাত্র লাভের জন্য মরিয়া এবং দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য তাদের প্রচেষ্টা পুরোপুরি লোক দেখানো।

বিগত তিন বছরে দ্বীপটিতে ৫ লাখ গাছ লাগানো হয়েছে বলে বেপজার দাবির কথা জানালে একরাম মিয়া বিদ্রূপ করে বলেন, “৫ লাখ? তারা হাতে গোনা কয়েকটি গাছ রোপণ করেছে, কিন্তু তা ৫ লাখের ধারে-কাছেও না। এছাড়া, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশিরভাগ গাছই টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।”

অন্যদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেপজার একজন কর্মকর্তা বলেন, “দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের যে কোনো ক্ষতির জন্য স্থানীয়রা দায়ী। ২০১৭ সালে কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণের পর দ্বীপে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে।”

সোনাদিয়া দ্বীপকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হলেও দ্বীপের বাসিন্দারা অবৈধ কাঠ কাটা, চিংড়ি চাষ এবং গবাদি পশু চড়ানোর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেন এই কর্মকর্তা।

“স্থানীয়রাই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বাধা সৃষ্টি করে। সেজন্য তাদের দ্বীপ থেকে সরানো দরকার,” উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, বেপজা এসব অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধ করেছে।

প্রকল্পটি সরানোর আহ্বান পরিবেশবাদীদের

পরিবেশবিদরা ইকো পার্কের জন্য অন্য কোনো এলাকা নির্বাচন করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছেন। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সর্বোত্তম উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও ভারি স্থাপনা নির্মাণ এবং পর্যটকদের আগমন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

অলিভ রিডলি প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ, হর্সশু কাঁকড়া, স্পুন-বিলড স্যান্ডপাইপারসহ সোনাদিয়া দ্বীপ পৃথিবীর বিরল কিছু প্রাণীর আবাসস্থল। এছাড়াও, দ্বীপ ও এর আশেপাশের এলাকা ইরাবদি এবং বটলনোজ ডলফিনের মতো বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে থাকা অনেক সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিচরণের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ জানান, সম্প্রতি দ্বীপে গিয়ে তিনি একটিও ডলফিন দেখতে পাননি।

“আমরা ২০১৯ সালে দ্বীপে গোলাপি ডলফিন দেখেছিলাম। কোভিড লকডাউনের সময়, সেই ডলফিনগুলোই কক্সবাজারে গিয়েছিল। কিন্তু পরে মাছ ধরার জাল দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। যে এলাকাটিকে প্রকল্প এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে সেটি ডলফিনদের একটি প্রধান বিচরণ এলাকা এবং নির্মাণ কাজ শুরু হলে এই পুরো চ্যানেল থেকে ডলফিনগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র,” তিনি বলেন।

তিনি পরিযায়ী পাখিদের ওপর এই প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ দ্বীপটি ৮০টিরও বেশি পরিযায়ী প্রজাতির পাখির আশ্রয়স্থল।

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, যিনি একটি এনজিওর হয়ে বেশ কয়েকটি সামুদ্রিক কচ্ছপের হ্যাচারি দেখাশোনা করেন, বলেন, “নভেম্বর থেকে মার্চ মাস সমুদ্র সৈকতে কচ্ছপদের ডিম পাড়ার আদর্শ সময় এবং আমি হ্যাচারিতে প্রজননের জন্য তাদের সংগ্রহ করি। আমি এই বছরের জানুয়ারিতে মাত্র ষোলটি কচ্ছপের ডিম পেয়েছি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। কচ্ছপগুলো আগের মতো সৈকতে আসছে না।”

পরিবেশ আইনজীবী এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “সোনাদিয়া এখনও একটি ইসিএ এলাকা কারণ আমাদের করা ব্যক্তিগত স্বার্থ মামলার পর হাইকোর্ট এখনও এটি বলবৎ রেখেছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপে নির্মাণ সম্পূর্ণ বেআইনি।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, “সরকার জালিয়ারদ্বীপ বা সাবরাং-এর মতো অন্য কোথাও এমন একটি দ্বীপ পর্যটন পার্ক বাস্তবায়ন করতে পারে। কেন তারা সোনাদিয়াকে রেহাই দিতে পারছে না?”

তবে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, “পরিবেশগত প্রভাব কমাতে দ্বীপে প্রতিদিন সীমিতসংখ্যক পর্যটককে অনুমতি দেওয়া হবে।”

দ্বীপের উপকূলে হাইরাইজ এবং হোটেল নির্মাণের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “দ্বীপে রাত থাকার অনুমতি দেওয়া হবে, তবে এখনই নয় আরও পরে। প্রথমত, আমরা পরিবেশবান্ধব পর্যটন এলাকায় কীভাবে আচরণ করতে হয় সে সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার দিকে মনোনিবেশ করব।”

বাঘ সংরক্ষণ শিখতে বিদেশ যাবেন ২০ কর্মকর্তা
পাসপোর্টের ভুল তথ্য সংশোধন করবেন যেভাবে

আপনার মতামত লিখুন