শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

আত্মমর্যাদার পদ্মা সেতু ও পর্যটন শিল্প

এম. তানজির এইচ রুবেল
৩০ জুন ২০২২

নানা প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যতগুলো অর্জন এসেছে ‘পদ্মা সেতু’ বাস্তবায়ন তার মধ্যে অন্যতম। কারণ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে দেশীয় বিরুদ্ধাচারেরা যেভাবে সক্রিয় ছিল একইভাবে তাদের বিদেশি প্রভুরাও সর্বস্ব দিয়ে বিরোধীতা করেছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে গিয়েও বাঙালি জাতিকে দেশি-বিদেশি বিরোধীতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সব অপচেষ্টা পদদলিত করে বাংলাদেশের অহঙ্কারের প্রতীক হিসেবে ‘পদ্মা সেতু’ আজ দীপ্যমান।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন শিল্পে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। যারা  পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা সবাই উচ্ছ্বসিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনে। যোগাযোগ খাতে পশ্চৎপদ দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সহজ যোগাযোগের জন্য নির্মিত পদ্মা সেতু দেশের গর্বের প্রতীক। এই সেতু বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। সেতুটি বাস্তবায়ন হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন স্থানগুলোতে ভ্রমণ অনেক সহজ এবং আরামদায়ক হবে। 

দক্ষিণাঞ্চলে  অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান পৃথবীর সর্ববৃহৎ শ্বাসমূলীয় বন ‘সুন্দরবন’। কিন্তু সুন্দরবন ভ্রমণে বিগত দিনে পর্যটকদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হতো এই পদ্মা নদী পারাপারে। ফেরি পারাপারের জটিলতায় পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গত ২৫শে জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। এখন সরাসরি পদ্মা সেতু পেরিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মতো পর্যটকরাও দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দর্শনীয় স্থান দেখেতে সহজে  যেতে পারবেন।  

সুন্দরবন পর্যটকদের ভ্রমণের একাধিক পথ থাকলেও আধুনিক এবং নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় খুলনা দিয়েই ট্যুর অপারেটররা ভ্রমণ আয়োজন করে। এই রুটে বিভিন্ন ধারণ ক্ষমতার প্রায় ৪২টি ট্যুরিস্ট শিপ রয়েছে। এই ট্যুরগুলো ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন (টোয়াস) এবং বাংলাদেশ বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।উল্লেখ্য সুন্দরবনে পৃথিবীখ্যাত বেঙ্গল টাইগারসহ বিচিত্র সব প্রাণীর আবাসস্থল। অপরূপ ভূপ্রকৃতি, সমুদ্র দর্শন এবং আরামদায়ক নৌ-ভ্রমণের ব্যবস্থা থাকায় দেশি পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় স্থান।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার এই আনন্দ মুহূর্তে এবং বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ মৌসুমে বন বিভাগের ৩ মাসের অপ্রত্যাশিত নিষেধাজ্ঞার কারণে সুন্দরবনে পর্যটন বন্ধ রয়েছে। তবে ৩ মাসের জন্য সুন্দরবনে পর্যটন বন্ধ থাকলেও খুলনা-মংলার ট্যুর অপারেটর, গাইড, কর্মচারীসহ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখো মানুষের মধ্যে আনন্দ বিরাজ করছে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে। আমরা যারা সুন্দরবননির্ভর পর্যটনকর্মী আছি তারা আশা করছি আসছে মৌসুমে পর্যটকদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হবে সুন্দরবন। কারণ ঢাকা থেকে অল্প সময়ের মধ্যে ঝামেলাহীন মুক্তভাবে ভ্রমণ করা সম্ভব হবে আমাদের গর্বের পদ্মা সেতুর কারণে। তাছাড়াও এ বছর পর্যটকেরা  কম সময়ে যাতায়াত করতে পারায় সুন্দরবন ভ্রমণের বাইরেও খুলনা-বাগেরহাটে অবস্থিত ষাট গম্বুজ মসজিদ,  খানজাহান আলী দীঘি, হাদিস পার্কসহ আরো দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে পারবেন।

সুন্দরবনের শুরুতেই কিছু  দর্শনীয় স্থান রয়েছে যেখানে দিনে গিয়ে দিনে ফেরা যায়। কিন্তু সুন্দরনন ভ্রমণের মূল আকর্ষণ ৩দিন ২ রাতের বনের গভীরে শিপের কেবিনে আরামদায়ক ভ্রমণের। যে ট্যুরে  রিভার ক্রুজ, ক্যানেল ক্রুজ, সুন্দরবনের অপরূপ বন-প্রকৃতি উপভোগ, বন্যপ্রাণী দেখা এবং সমুদ্র সৈকতে বেড়ানোর সুযোগ থাকে। সে সব ট্যুরে প্রয়োজনীয় উন্নতমানের ব্যবস্থা এবং খাবারসহ সম্পূর্ণ প্যাকেজ আয়োজন করে থাকে সংশ্লিষ্ট ট্যুর অপারেটর।

পদ্মা সেতুর কারণে বর্তমানে মাত্র ৩-৪ ঘণ্টায় খুলনা বা মংলায় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় পরিবহণ যাতায়াত করবে যা ঢাকার সায়েদাবাদ, গুলিস্থান, আরামবাগ  রাজারবাগ, কল্যাণপুর, গাবতলীসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছেড়ে যাবে আবার ভ্রমণ শেষে ফেরত নিয়ে আসবে। খুলনা বা মংলার বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন নদীর ঘাট থেকেই নির্ধারিত শিপে ওঠা যাবে।

বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল এই সুন্দরবন ভ্রমণ অন্য যে কোনো ভ্রমণ স্থান থেকে ভিন্ন। এখানে পর্যটকদের  নিরাপত্তা এবং বনের পরিবেশ রক্ষা করে ভ্রমণ করা হয়। আসছে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দররবনের পর্যটন আরম্ভ হবে। বর্ষার শেষের দিকে সুন্দরবন অতুলনীয় সৌন্দর্য ধারণ করে। তাই সুন্দরবন ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে ভ্রমণে করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ করছি।

সুন্দরবনে ভ্রমণকালে উজ্জ্বল রঙের কাপড় (যা অনেক দূর থেকে চোখে পরে) পরিহার করতে হবে। হালকা রঙের এবং ঢিলেঢালা ফুল স্লিপ পোশাক পরতে হবে। কোনো প্রকার সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না। পিছনে বেল্ট আছে এবং পানিতে ভিজলে নষ্ট হবে না এমন সেন্ডেল/ কেডস সঙ্গে নিতে হবে। সু/ হাই হিল নিবেন না। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরে লাগেজের সাইজ ছোট হওয়া ভালো। জঙ্গলে নামার পর কোনো অবস্থাতে উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না এবং খুব প্রয়োজন না হলে কথা না বলেই ট্রাকিং করতে হবে। শিপের মধ্যেও কোনো অবস্থাতেই উচ্চ আওয়াজে সাউন্ড সিস্টেম বাজানো যাবে না। যেহেতু শিপে ব্যবহার্য প্রয়োজনীয়  কিছু  খুলনা থেকে নিয়ে উঠতে হয়; নতুন করে কিছু সংগ্রহ করা সম্ভব নয় তাই পানি বা অন্য কোনো ব্যবহার্য দ্রব্য অপচয় করা যাবে না। (এখানকার নদীর পানি লবণাক্ত)। খাবার পানি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। জঙ্গলে নামার পর সুশৃংখলভাবে হাঁটতে হবে এবং কোনো অবস্থাতে দল ছুট হওয়া যাবে না। গাছের ডাল, পাতা বা লতায় হাত দেওয়া বা ছেঁড়া যাবে না। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না এবং পলিথিন বা প্যাকেজিং বস্তু যত্রতত্র ফেলা যাবে না। গাইড এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। যে কোনো ধরনের ড্রোন, বৈধ বা অবৈধ আগ্নেয় অস্ত্র বহন বা ব্যবহার  সুন্দরবনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

লেখক: সিইও, ফেমাস ট্যুরস বিডি

পাল্টে যাবে দক্ষিণের পর্যটন
এখনও অনিশ্চয়তায় বরিশাল পর্যটন মোটেল প্রকল্প

আপনার মতামত লিখুন