বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অর্থনীতি

শ্রীমঙ্গলের আয়ের প্রধান উৎস হবে পর্যটনসংশ্লিষ্ট খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৮ মে ২০২২

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড যে ‘মেগা প্রজেক্ট’ বা মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে শ্রীমঙ্গলের আয়ের প্রধান উৎস হবে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসাবাণিজ্য। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজিয়ে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। অবকাঠামোগত এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এখানে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানই রমরমা ব্যবসা বাণিজ্য করবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ঈদের ছুটিতে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক ভ্রমণ করেছেন চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল। তাদের দাবি গত কয়েক দিনে অন্তত অর্ধ লক্ষাধিক পর্যটক উপভোগ করেছেন এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখানে মূলত দুই ধরনের পর্যটক বেড়াতে আসেন। এক শ্রেণীর পর্যটক আসেন যারা সকালবেলা শ্রীমঙ্গল পৌঁছে সারা দিন ঘোরাঘুরি করে বিকেল বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যান। আর অন্য শ্রেণীর পর্যটকরা হলেন তারা বিভিন্ন রিসোর্ট বা হোটেলে অবস্থান নিয়ে অবকাশ যাপন করেন এবং এলাকায় ঘুরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডসহ সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, এখানে পর্যটন শিল্পকে গতিশীল করতে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি মানসম্পন্ন আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, খাবার হোটেল, বিনোদনকেন্দ্র, ক্লাব, তথ্যকেন্দ্র, পর্যটন মোটেল নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে।

বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে সরকারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে মূলত তিন ধাপে। পর্যটনের ভিশন ও মিশন ঠিক করা, কৌশলগতভাবে উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করা, অগ্রাধিকার এবং এরিয়া নির্দিষ্ট করে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা প্রস্তুত। এছাড়া মেলা, ফেস্টিভাল, কার্নিভাল, কালচারাল অনুষ্ঠান, ব্র্যান্ডিং, সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা, ভিডিও নির্মাণ, ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শনী ও ওশান ট্যুরিজমকে বেসরকারি উদ্যোগে চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শ্রীমঙ্গল হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটন নগরী। এরই লক্ষ্যে সরকার দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে যে ‘মেগা প্রজেক্ট’ হাতে নিয়েছে এর মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে শ্রীমঙ্গলের নাম রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের নিরাপদ অবকাশ যাপনের জন্য শ্রীমঙ্গল হবে দেশের অন্যতম গন্তব্য। তখন পর্যটকরা শ্রীমঙ্গলেই অবস্থান করে পুরো সিলেট ভ্রমণের পরিকল্পনা করবেন।

সংশ্লিষ্টদের দাবি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে যেমন রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের অনন্য দৃষ্টান্ত, তেমনি রয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সম্প্রীতির মানুষদের মহামিলনের নজির । স্থানীয়দের মতে এসব সম্ভব হয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মনোভাব, বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলী চিন্তাচেতনার ফলে। বিশেষ করে স্থানীয় এমপি উপাধ্যক্ষ ড. মো: আব্দুস শহিদ ও পৌরমেয়র মহসিন মিয়ার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফলে এই এলাকাটি শান্তির শহরে রূপ নিয়েছে। যদিও দু’জন দুই মেরুর রাজনীতির সাথে যুক্ত।

ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইডরা জানান, বিশৃঙ্খলা ও চাঁদাবাজমুক্ত পর্যটন নগরী গড়তে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। পর্যটকদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ, থানা পুলিশ, র্যাবসহ প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। ফলে এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে, নির্বিঘেœ, নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারছেন।

শ্রীমঙ্গলে এরই মধ্যে পাঁচতারকা মানের হোটেলসহ মানসম্পন্ন বিভিন্ন হোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। বেশ কিছু রিসোর্ট রয়েছে নির্মাণাধীন। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ও ঢাকার খুব কাছের এই চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গল থাকায় সহজেই অবসর যাপন করতে আসছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সংখ্যায় কম হলেও কিছু বিদেশী পর্যটকের দেখাও মিলেছে গত মৌসুমে। তবে পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশে আসা বিদেশী পর্যটকদের প্রথম স্থান হবে শ্রীমঙ্গল- এমনটাই বলছেন স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা।

এদিকে দুই বছর মহামারীর পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই দেশীয় পর্যটকদের ঢল নামে শ্রীমঙ্গলে। আগত এসব পর্যটককে সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে রেস্টুরেন্ট ও হোটেল রিসোর্ট মালিকদের।

এ ব্যাপারে গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গল্ফের মিডিয়া কর্মকর্তা পলাশ চৌধুরী জানান, গত বছরের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই গেস্টদের চাপ বেশি ছিল। রমজান মাসে কিছু কম থাকলেও গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে হাউজফুল যাচ্ছে আমাদের রিসোর্টটি।

ট্যুর অপারেটর মো: খালেদ হোসেন জানান, যে পরিমাণ পর্যটক শ্রীমঙ্গলে আসছেন সে তুলনায় আবাসন স্থাপনা ও মানসম্পন্ন খাবার হোটেল কম রয়েছে। ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে সম্ভাবনাময়ী এ শিল্পকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ট্যুরিজম বোর্ডের সাথে সমন্বয় রেখে শ্রীমঙ্গলকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়তে কাজ করে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি আশা প্রকাশ করেন, যোগাযোগব্যবস্থা ও এখানকার পরিবেশ, পরিস্থিতি ঠিক থাকলে এবং সরকারের যে পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে শ্রীমঙ্গলে সারা বছরজুড়েই পর্যটকদের আনাগোনা থাকবে। পাশাপাশি আগামী চার-পাঁচ বছর পর এখানে আয়ের প্রধান উৎস হবে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসাবাণিজ্য।

তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির ৩৯টি সূচক পূর্ণ করবে বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এ ৩৯টি সূচকের বাইরে স্থানীয়ভাবে আরো একটি বাড়তি সূচক পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর জন্য দেশের সবকটি উপজেলায় স্থানীয় সম্ভাবনাময় খাত চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা থেকে এই বাড়তি সূচক পূরণের জন্য বেছে নেয়া হয় পর্যটন শিল্পকে। ২০৩০ সালে পর্যটন শিল্পেই ঘুরবে এ উপজেলার অর্থনীতির চাকা।

তিনি আরো জানান, বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন শ্রীমঙ্গলে প্রায় পাঁচ হাজার পর্যটক আসছেন। স্থানীয় অর্থনীতির ৪০ শতাংশ আসছে এই পর্যটন শিল্প থেকে। ২০৩০ সালের মধ্যে পর্যটকের সংখ্যা তিন গুণ বাড়িয়ে দৈনিক ১৫ হাজারের টার্গেট নেয়া হয়েছে। মাসে চার লাখ ৫০ হাজার এবং বছরে পর্যটকের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৪ লাখ। তখন স্থানীয় অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আসবে এই পর্যটন খাত থেকে। এ লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসন থেকে এ উপজেলার পর্যটন শিল্পের বিকাশে ‘রূপময় শ্রীমঙ্গল’ নামে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার উপজেলা পরিষদের হলরুমে এ ডকুমেন্টারিটির প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়। ১২ মিনিটের ডকুমেন্টারিতে তুলে ধরা হয়েছে এ উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের পরিচালক আবু তাহের মো: জাবের বলেন, শ্রীমঙ্গল তথা সিলেট অঞ্চল হচ্ছে পর্যটন শিল্পের জন্য একটা উর্বর ভূমি। সরকার পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন জেলায় যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেখানে উপজেলা পর্যায়ে শ্রীমঙ্গলের নাম রয়েছে। শ্রীমঙ্গল পর্যটন শিল্পের জন্য অপার সম্ভাবনাময়ী একটা এলাকা। এখানে পর্যটকদের সেবা প্রদানের জন্য উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শ্রীমঙ্গলসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় রমরমা ব্যবসাবাণিজ্য হবে।

পর্যটনে নয়া দিগন্ত
ওয়ালটনের সহযোগিতায় নিউ ইয়র্কে ‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট’

আপনার মতামত লিখুন