মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪ | ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয়

পর্যটকের সংখ্যা দুকোটি ছাড়িয়েছে

করোনার মাঝেও পর্যটনে বিশ্ব রেকর্ড

ডেস্ক রিপোর্ট
০২ জানুয়ারি ২০২২

করোনা মহামারীর মাঝেও অভ্যন্তরীণ পর্যটনে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। শুধু বিদায়ী বছরেই দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। 

গত বছর বিশ্বের কোন দেশের পক্ষে আর এত বিপুল সংখ্যক পর্যটকের দেখা মিলেনি। সিট ছিল না কোথাও- সরকারী-বেসরকারী, ছোট-বড় কোন হোটেল-মোটেলেই। চলতি বছর এ রেকর্ডও ছাড়িয়ে যাবে। আগামী তিন বছরেই অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ৫ কোটিতে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোারেশন। 

বিগত ৫০ বছরে দেশের পর্যটন শিল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এমন তথ্যই জানালেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মাহবুব আলী এমপি। তিনি জানিয়েছেন, শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, গোটা বিশ্বের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি বিগত পঞ্চাশ বছরে কমপক্ষে ১০ কোটি পর্যটককে সেবা দিয়েছে।

পর্যটন সূত্র জানিয়েছে, আগামী পঞ্চাশ বছরের মহাপরিকল্পনাতেও বয়েছে বিশেষ চমক। দেশের কোন জেলায় কি ধরনের পর্যটন কেন্দ্র গড়া সম্ভব- সেটার সম্ভাব্যতাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে মহাপরিকল্পনায়। বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্রগুলোর রূপরেখা প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মাহবুব আলী জানিয়েছেন- জাপান, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশই কক্সবাজারাকে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে। কার প্রস্তাবে দেশ কতটা সুবিধা পাবে এখন সেটার তুলনামূলক বিশ্লেষণ চলছে।

উল্লেখ্য, এ দেশে পর্যটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই আগলে রেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারী-বেসরকারী পর্যটন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে এ দেশের প্রতিটি জেলা ভ্রমণ করেছেন। হৃদয়ে ধারণ করেছেন মানুষকে, উপলব্ধি করেছেন বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য। এ দেশের অপার সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বারবার। বঙ্গবন্ধু জানতেন, পর্যটন শিল্পের পরিকল্পিত বিকাশের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যেমন সম্ভব, তেমনি পর্যটনের মাধ্যমেই সারাবিশ্বে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, পুরাকীর্তি ও প্রত্নতত্ত্ব, ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা, দিগন্ত বিস্তৃত হ্রদ, চা বাগান ও নদীর সৌন্দর্যসহ বাংলাদেশের প্রকৃতির অপরূপ রূপ সফলভাবে তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে। প্রকৃতি ও মনুষ্যসৃষ্ট সকল নান্দনিক সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যকে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে ১৯৭২ সালেই ‘প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার-১৪৩’ বলে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’, যা এ দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান। এমনকি, বরেণ্য চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকার ও পটুয়া কামরুল হাসানের অঙ্কিত পর্যটন কর্পোরেশনের লোগোটিও পছন্দ করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করা জাতির পিতার স্মৃতিধন্য পর্যটন কর্পোরেশন নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন ৫০ বছরে পদার্পণ করল।

পর্যটন কর্পোরেশন জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠালগ্নে মাত্র ৭টি বাণিজ্যিক ইউনিট নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বর্তমান ইউনিট সংখ্যা ৫০টি। আরু বেশ কয়েকটি ইউনিট চালু হবার অপেক্ষায় রয়েছে। পেরিয়ে আসা দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন দেশের আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকাসমূহে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, ডিউটি ফ্রি অপারেশন্স, বার, রিসোর্ট, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ইত্যাদি নির্মাণ করে পর্যটকদের মানসম্মত খাবার, আবাসন এবং নানাবিধ পর্যটনসেবা প্রদান করে আসছে। দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারসহ দেশের অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকাসমূহকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতেও বিগত বছরগুলোতে যথেষ্ট অবদান রেখেছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। পর্যটন শিল্পসংশ্লিষ্টদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য দেশের প্রথম ও একমাত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ন্যাশনাল হোটেল ও ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটটিও পরিচালনা করে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন।

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রতিষ্ঠিত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিবছর ১৬০০ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ষাট হাজারের অধিক দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করেছে, যারা দেশ-বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করে চলেছে। দেশে পর্যটন শিল্পের প্রসারের কারণে এ খাতে দক্ষ জনশক্তির ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সদয় নির্দেশনায় ২০১৭ সালে ন্যাশনাল হোটেল এ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটটি আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে হাতে নেয়া কাজ সমাপ্তির পথে। এছাড়াও এখানে কর্মরত প্রশিক্ষকদের উন্নত ও নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যটনসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের দক্ষ জনশক্তির অধিকতর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল যে পর্যটন শিল্পের, সময়ের পরিক্রমায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুমাত্রিক নেতৃত্বে ধারাবাহিক উন্নয়নের মাধ্যমে বিকশিত হয়ে উন্নীত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানে। প্রধানমন্ত্রীর পর্যটনবান্ধব নীতিমালা ও কার্যক্রমের ফলে দেশের পর্যটন শিল্প এখন বিকাশের নতুন অধ্যায়ে উপনীত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বিপুলভাবে বিকশিত হচ্ছে এ খাতের বেসরকারী উদ্যোগ, যা এ শিল্পের জন্য খুবই ইতিবাচক। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বিশেষ প্রাপ্তি এ সংস্থার প্রধান কার্যালয় ‘পর্যটন ভবন’। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম চালিয়ে আসা সংস্থাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদান্যতায় রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকায় খুঁজে পেয়েছে তার কাক্সিক্ষত স্থায়ী ঠিকানা।

এ বিষয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (বাপক) পর্যটক সেবায় হোটেল-মোটেল ও রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করে থাকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পরিচালন ও সেবা প্রদানের আঙ্গিকে নানা পরিবর্তন এসেছে। যুগের চাহিদার প্রেক্ষিতে এর সেবা আধুনিকায়ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত ১২ বছরে প্রায় ২৮৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে পর্যটন কর্পোরেশন। ইতোমধ্যে বাপকের বিদ্যমান ১০টি হোটেল-মোটেলের সংস্কার, ৮টি গাড়ি সংগ্রহ করা, কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় চেঞ্জিং ক্লোসেট নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। সংস্থার সকল বাণিজ্যিক ইউনিটকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনা হয়েছে। সিলেটের লালাখান, কুমিল্লার জোড়কানন দীঘি, নাটোর, শেরপুরের গজনী ও নেত্রকোনা জেলার বিজয়পুরে পর্যটকদের সুবিধাদি সম্বলিত সেবাকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ সংস্থার বাণিজ্যিক ইউনিটসমূহে ডিজিটাল সাইনেজ এবং আইপি ক্যামেরা ও সাউন্ড সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ৩৩৫ কোটি টাকার ১২টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে যার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চট্টগ্রামস্থ আনোয়ারা উপজেলার পারকিতে পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন, টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামীণ পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রেখে গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন এবং বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাঘিয়াকূল নদীর স্টিমার ঘাটে পর্যটন সুবিধাদি সৃষ্টি, পঞ্চগড়ে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ, সুনামগঞ্জস্থ টেকেরঘাটে জলবায়ু সহিষ্ণু দায়িত্বশীল পর্যটন ব্যবস্থা প্রবর্তন, কক্সবাজার জেলার খুরুশকূলে শেখ হাসিনা টাওয়ার নির্মাণ এবং পর্যটন জোন স্থাপন সমীক্ষা প্রকল্প, বরিশালের দুর্গাসাগরে পর্যটন সুবিধাদি নির্মাণ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মহানন্দায় শেখ হাসিনা সেতুসংলগ্ন এলাকায় পর্যটন সুবিধাদি নির্মাণ, নোয়াখালী জেলার হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ, দেশের অভ্যন্তরে প্যাকেজ ট্যুর চালু করার লক্ষ্যে ৬টি ট্যুরিস্ট বাস ক্রয়, নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার আদর্শনগরে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ।

বর্তমানে দেশে পর্যটন খাতের সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে এ্যাডভোকেট মাহবুব আলী বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে দেশে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। জন্মলগ্ন থেকেই সংস্থাটি সরকারী বরাদ্দ ও নিজস্ব আয় থেকে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। পর্যটকদের কাছে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য এবং মানসম্মত অতিথিসেবার বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার অর্ধশতাব্দীর অভিজ্ঞতা এবং সময়োপযোগী কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে দেশের পর্যটন শিল্পকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে আগামীতেও নেতৃত্বের জায়গায় থেকে কাজ করবে মর্মে আমার বিশ্বাস।

দুই বছর ধরে অনিশ্চতার দোলাচলে ঝুলছে
শীতের অতিথি পাখির দেখা পাবেন দেশের যেসব স্থানে

আপনার মতামত লিখুন