বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয়

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পর্যটন

ঈদের লম্বা ছুটিতে উজ্জ্বল সম্ভাবনা

ডেস্ক রিপোর্ট
২৮ এপ্রিল ২০২২

ঈদ ঘিরে বিপুল সম্ভাবনায় জমে উঠছে পর্যটন শিল্প। করোনার তা-বে দু’বছরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা পর্যটনে এবারই প্রথম দেখা দিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর উজ্জ্বল সম্ভাবনা। পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে কেন্দ্র করেই এই ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু, যা আগামী দু’বছরের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে যাবে আগের রূপে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাত দেশী-বিদেশী পর্যটক বাড়ার মূল কারণ হচ্ছে, একদিকে করোনা তা-বের দরুন দু’বছর সবকিছু বন্ধ থাকা। অন্যদিকে, দীর্ঘ ৯ দিনের ছুটি পাওয়া। মূলত এবার রোজা ৩০টি হলে ঈদ হবে ৩ মে মঙ্গলবার। ফলে ঈদের ছুটি ২ মে থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ৪ মে বুধবার। অন্যদিকে, ১ মে রবিবার শ্রমিক দিবসে সরকারী ছুটি। আর আগের দিন ৩০ এপ্রিল শনিবার, ২৯ এপ্রিল শুক্রবার। ফলে ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত টানা ৬ দিনের ছুটি। অন্যদিকে, ঈদের ছুটির পর ৫ মে বৃহস্পতিবার। তারপর ৬ ও ৭ মে পডবে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে চাকরিজীবীরা ৫ মে একদিন ছুটি পেলে মোট ৯ দিন ছুটি কাটাতে পারবেন ঈদে। এটাই বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে পর্যটনখাত চাঙ্গার।

দেশের সরকারী-বেসরকারী খাতের পর্যটন শিল্পসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত দু’বছর করোনায় যে সর্বনাশ ঘটেছে- তা ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু হয়েছে চলতি রমজানেই। কোথাও ঠাঁই নেই। দেশে-বিদেশে ঈদের ছুটিকে কাজে লাগানোর জন্য ভ্রমণকেই শীর্ষে রেখেছেন বিপুলসংখ্যক লোক। নিন্ম, মধ্য বিত্ত থেকে শুরু করে বিত্তবান- সব শ্রেণীর ভ্রমণপিপাসুরাই এই ঈদেই ঘর থেকে বের হবেন দু’পা ফেলতে। কি দেশ, কি বিদেশ, যার যেখানে সামর্থ্য সেখানেই ছুটছেন তারা। শুধু সরকারী হিসেবেই দেখা গেছে- এই ঈদেই ৮ থেকে ৯ লাখ মানুষ ছুটে যাবেন দেশের বাইরে। এর মধ্যে শুধু ভারতে যাওয়ার জন্যই ভিসা নিয়েছেন পাঁচ লাখ লোক। ভারত ছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, দুবাই ও তুরস্কে ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য আরও অন্তত তিন লাখ লোক ভিসা নিয়েছেন। তারা অন্তত এক সপ্তাহ দেশের বাইরে কাটানোর পরিকল্পনা করে রেখেছেন। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জমে উঠেছে অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত। কক্সবাজারের কোন হোটেল-মোটেলে নেই কোন সিট। তিল ধারনের ঠাঁই নেই পর্যটন-নগরীতে। একই অবস্থা এয়ারলাইন্সগুলোতে। কোন এয়ারেই টিকেট নেই ঈদের আগে-পরের দুদিনের।

অভ্যন্তরীণ দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাতায়াত বাড়ছে পর্যটকদের। সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। রাঙ্গামাটি আর বান্দরবানসহ অন্যান্য দর্শনীয় স্থানও মুখরিত হয়ে উঠছে। হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউসে খালি রুম পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। পর্যটকদের জমজমাট উপস্থিতিতে ব্যবসা জমে উঠছে। অভ্যন্তরীণ পর্যটক এরই মধ্যে অনেক বেড়েছে। কক্সবাজার ও কুয়াকাটাতে অন্যান্য সময়ের তুলনায় পর্যটক এখন অনেক বেশি। ফলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে পর্যটন খাত।

পর্যটন খাতের অন্যতম অংশীদার দেশের এয়ারলাইন্সগুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেমন রমরমা তাদের ব্যবসা। রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স বিমান, বেসরকারী ইউএস বাংলা ও নভো এয়ারে যাত্রীর চাপ বেড়েছে অনেক। শুধু ঈদের দিন থেকে দেশের কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ অন্যান্য এলাকার চাপ পড়েছে আকাশপথেও। বিমান জানিয়েছে, এয়ারলাইন্সটি আগে যেখানে ছোট এয়ারক্রাফট ব্যবহার করত, এখন সেখান থেকে সুপরিসর মডেলের প্লেন অপারেট করতে হচ্ছে। যে কারণে বিমানের টিকেট মোটামুটি এখনও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ইউএস বাংলা ও নভো এয়ারের ঢাকা-কক্সবাজার রুটে আগামী ২ থেকে ৭ মে পর্যন্ত ৯০ শতাংশ টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। ইউএস বাংলার মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঈদে কক্সবাজারের টিকেট প্রায় সব বিক্রি হয়ে গেছে। চাহিদার বিপরীতে এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে। ফলে ফ্রিকোয়েন্সিও বাড়াতে হতে পারে।

টোয়াব (ট্যুর অপারেটর্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) সূত্রে জানা গেছে, একদিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে চলে আসায়, অন্যদিকে টানা ৯ দিনের ছুটির ফাঁদে মানুষ একটি লম্বা সময় হাতে পেয়েছে ভ্রমণ কিংবা ঘোরার। যে কারণে এবার একটু ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। কক্সবাজারসহ অন্যান্য ট্যুরিস্ট জোনের হোটেল-মোটেলগুলোর বুকিং প্রায় শেষের পথে।

জানতে চাইলে পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আলী কদর দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলো আগের চেয়ে ভাল। যদিও আমার হাতে ঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই- তবুও বলতে পারছি এখন আগের তুলনায় পর্যটক বাড়ছে।

পর্যটন কর্পোরেশনের অপর একজন মহাব্যবস্থাপক বলেন, করোনাকালেও অপ্রত্যাশিতভাবে ভাল যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত। অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলও বেড়ে যাওয়ায় পর্যটক বেড়েছে। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। আগের চেয়ে বড় বড় উড়োজাহাজ দিয়ে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী যাতায়াত করছে। এটা কেউ আশা করেনি। এই চাহিদা কাজে লাগিয়ে পর্যটনের নতুন নতুন স্থান উন্নয়ন করতে হবে, যেখানে পর্যটকদের আগ্রহ রয়েছে।

পর্যটন বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, ঈদকে কেন্দ্র করে যেভাবে চাঙ্গা হয়েছে, তাতে আগামী দু’বছরের মধ্যেই আগের মতোই ঘুরে দাঁড়াবে পর্যটন খাত। এটা বিশাল প্রাপ্তি হবে গোটা দেশের জন্য। এই ঈদেই যে পর্যটন জমে গেছে- তার বড় লক্ষণ দেশ-বিদেশের পর্যটন নগরীর হোটেল-মোটেলে আসন ও এয়ারলাইন্সগুলোর টিকেট সঙ্কট। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে টিকেটের ৯০ ভাগই শেষ হয়ে গেছে বিমান, ইউএস বাংলা ও নভোএয়ারের।

টোয়াব সভাপতি রাফিউজ্জামান বলেছেন, দীর্ঘদিন পর খুলে দেয়ায় ভিড় বাড়তে শুরু করেছে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। কঠোর বিধিনিষেধে বন্ধ থাকায় আর্থিক অনটনে পড়লেও এখন নতুন উদ্যমে কাজ করছেন এ খাতের পেশাজীবীরা। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলে ঠাঁই নেই বললেই চলে। একইভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে পর্যটকদের ঘোরাফেরা বেড়েছে। তবে করোনা সংক্রমণের হার কমে এলেও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে সচেতন থাকার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।

জানতে চাইলে বিআইএইচএ সভাপতি এইচ এম হাকিম আলী সম্প্রতি বলেন, এখন মনে হচ্ছে সবই ভালর দিকে যাচ্ছে। ক্রমশই পর্যটক বাড়ছে। স্থানীয় পর্যটকরা ঘুরতে বের হচ্ছেন। নতুন নতুন রিসোর্টও হচ্ছে। ফলে এক ধরনের চাঙ্গাভাব দেখছি। কিন্তু তারকা হোটেলগুলোর কোন উন্নতি হয়নি। দেশের যে সব পর্যটক এতদিন বিদেশে ঘুরতেন, তারা এখন স্থানীয় দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে বেরুহচ্ছেন। এটা আমাদের পর্যটনশিল্পে ইতিবাচক দিক। তিনি পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বলেন, আগামী তিন বছরের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার সুদমুক্ত ঋণ চাই। করোনা সঙ্কট কেটে গেলে বিদেশী গণমাধ্যমে প্রচার চালাতে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের আহ্বান জানাই।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যটন খাতে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। পাশাপাশি দেশকে আরও বেশি করে তুলে ধরার সুযোগ তৈরিও হয়েছে। জাতিসংঘের পর্যটনবিষয়ক সংস্থা ইউএনডব্লিউটিও। সম্প্রতি সংস্থাটির কমিশন ফর সাউথ এশিয়ায় (সিএসএ) ২০২১-২৩ মেয়াদে ভাইস চেয়ার নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। এর প্রেক্ষাপটে নড়েচড়ে বসেছে এ খাতের নীতিনির্ধারকরাও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান ও জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের সমাগম বৃদ্ধি পাওয়ায় সে সব এলাকার হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ ও পরিবহন মিলিয়ে সব ব্যবসায়ই যেন এখন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তবে করোনার কারণে বিদেশ ভ্রমণের ঝামেলা থাকায় পর্যটক তথা ভ্রমণপিপাসুরা দেশের ভেতরেই ঘুরতে যাচ্ছেন।

টোয়াব সূত্রে জানা গেছে, করোনার আগে প্রতিবছর গড়ে ৫০ থেকে ৬০ লাখ পর্যটক দেশের বিভিন্ন স্পটে ভ্রমণ করেন। তবে এবার করোনার কারণে পর্যটন ব্যবসা থমকে যায়। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় সব খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে আবার জমতে শুরু করেছে এই খাতের ব্যবসা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে দুই সপ্তাহ ধরে চলছে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলোতে নানা ধরনের মূল্যছাড়ের অফার।

জানতে চাইলে টোয়াব সভাপতি মোঃ রাফেউজ্জামান বলেন, এটা ভাল লক্ষণ। পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে কেন্দ্র করে যেভাবে হোটেল-মোটেল ও বিমানের টিকেট সঙ্কট দেখা দিয়েছে- তা তো ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ঘরে বসে থেকে হাঁপিয়ে উঠছিল। সবকিছু খুলে দেয়ায় তারা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কিংবা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের বুকিং দেখলেই তা বোঝা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারীর কারণে গত বছর কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে জনসমাগম ছয় মাস বন্ধ ছিল। এবারও তা প্রায় চার মাস বন্ধ থাকে। জীবিকা নিয়ে বিপাকে পড়েন পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে জীবিকানির্বাহ করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। পর্যটকরা না থাকলে অনেক সমস্যা হয় ব্যবসা চালাতে। সব বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। এখন আগের থেকে বিক্রি অনেক বেড়েছে। অনেকদিন পর আবার ব্যবসা ভাল হচ্ছে। মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। এখন আর সেই অবস্থা নেই। সাগর পাড়ে ভাড়ায় কাজ করা ফটোগ্রাফার আর বিভিন্ন রাইডের ব্যবসায়ীরাও মানবেতর জীবন শেষে স্বপ্ন দেখছেন সচ্ছলতার। এরই মধ্যে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে শুরু করছে সাগর পাড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেলগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলগুলোতে আগামী ২ থেকে ৪ মে পর্যন্ত কোন আসন ফাঁকা নেই। তারপরের দিনগুলোতেও একই ধারা বজায় থাকবে। কক্সবারের টিউলিপের কর্মকর্তা বলেন, ছুটির দিনগুলোতে প্রচুর পর্যটক আমাদের এখানে আসেন। কোন কক্ষ খালি নেই। সামনেও তাই থাকবে।

সার্বিক পরিস্থিতি এখন কেমন জানতে চাইলে কক্সবাজার হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস, অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ কলিম বলেন, এবার ভালই দেখা যাচ্ছে। রমজান মাস হলেও আগাম বুকিং চলছে। ঈদের পর থেকেই বেশিরভাগ বুকিং দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড জানিয়েছে, পর্যটকদের নানা ধরনের সেবা প্রদানের জন্য করণীয় বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এতে ট্যুর অপারেটর, ট্র্যাভেল এজেন্ট, হোটেল, রেস্তোরাঁ, এয়ারলাইন্স, ট্যুরিস্ট কোচসহ পর্যটনের সঙ্গে জড়িত নানা পক্ষের জন্য আলাদা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর পর থেকে যে সব স্বাস্থ্যবিধি রয়েছে, সেগুলো মানা ছাড়াও পর্যটকদের ভ্রমণে যাওয়ার আগে অনলাইনে বুকিং ও অর্থ পরিশোধ করতে বলা হচ্ছে। বড় দলে ভ্রমণের পরিবর্তে কম সদস্য ও পারিবারিক ভ্রমণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সেবা গ্রহণের পূর্বে হোটেল, রেস্তোরাঁ, স্থানীয় পরিবহন, গাইড, স্যুভেনির শপ ইত্যাদির কোভিড-১৯ বিষয়ে নিরাপত্তা বিধানের সক্ষমতা রয়েছে কিনা- তা যাচাই করে বুকিং দেয়া, হোটেলে অবস্থানকালে বহিরাগত কারও প্রবেশ নিরুৎসাহিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করায় বাংলাদেশে এ শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। সম্প্রতি পর্যটন খাতে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। পাশাপাশি দেশকে আরও বেশি করে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের পর্যটনবিষয়ক সংস্থা ইউএনডব্লিউটিওর কার্যক্রম পরিচালিত হয় ছয়টি আঞ্চলিক সংগঠনের সমন্বয়ে। যার মধ্যে কমিশন ফর সাউথ এশিয়া (সিএসএ) অন্যতম। ১৪ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির কমিশন ফর সাউথ এশিয়ায় (সিএসএ) ২০২১-২৩ মেয়াদে ভাইস চেয়ার নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। এতে পর্যটন খাতে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। পাশাপাশি দেশকে আরও বেশি করে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ।

এ অর্জনে কী কী সুফল আসবে জানতে চাইলে জাবেদ আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যটনে আমাদের নেতৃত্ব দেয়া এবং ভূমিকা রাখার জায়গা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের পযর্টনকে আরও পরিচিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার জায়গায় বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নেও ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি হলো। তিনি আরও বলেন, কমিশন ফর সাউথ এশিয়ায় ভাইস চেয়ার হওয়ার ফলে আমরা এখন যে কোন অনুষ্ঠান বাংলাদেশে করার প্রস্তাব করতে পারব। এখন বিভিন্ন দেশের পর্যটনের শীর্ষ ব্যক্তিরা আসবেন এখানে। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানবেন। এর সুফল আমরা পাব। এর আগে ২০১৯-২১ মেয়াদে কমিশন ফর সাউথ এশিয়ার ভাইস চেয়ার ছিল ভারত ও শ্রীলঙ্কা। তারাও এর সুফল পেয়েছে। তাই দেশের পর্যটন ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে কাজ করার কথা বললেন।

জানতে চাইলে নতুন সম্ভাবনায় ঘুরে দাঁড়াবে পর্যটন খাত বলে উল্লেখ করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ রিকভারি প্ল্যান নেয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ফলে সঙ্কট কাটিয়ে আবারও পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াবে। আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে পর্যটন খাত সংশিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান। যারা বেকার হয়েছেন, তারা আবারও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। রিকভারি প্ল্যানে অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে পর্যটন খাতের বিকাশের যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে সেটিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

পর্যটকদের সংগঠন টোয়াব সভাপতি মোঃ রাফেউজ্জামান বলেন, দেশী-বিদেশী সব ক্ষেত্রেই পর্যটনের পালে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। ঈদের পর থেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনশিল্প চাঙ্গা হবে। এতে উদ্যোক্তাদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। ফলে দেশীয় পর্যটন খাত লাভবান হচ্ছে। অংশীজনরা ব্যবসায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এককথায় পর্যটন খাতে কর্মযজ্ঞ বাড়ছে। কেননা, জনজীবন যখন স্বাভাবিক হবে, স্বস্তি ও শান্তিময় হবে, তখনই মানুষ ঘুরে বেড়াবেন। আগামীতে এক কোটির বদলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ঘুরে বেড়াতে পারেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাকালে ঘর থেকে বেরোতে পর্যটনমুখী হয়ে আছেন অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা। তারা আস্তে আস্তে ঘুরতে বেরও হচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন সমুদ্রে, কেউ যাচ্ছেন পাহাড় কিংবা সমতলের দর্শনীয় স্থানগুলোতে। এককথায় বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির উষ্ণতা খুঁজছেন। ফলে জমে উঠছে দেশের পর্যটন শিল্প। স্থানীয় পর্যটকদের পদচারণায় এরই মধ্যে মুখরিত হয়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও সাগরকন্যা কুয়াকাটা।

টোয়াব সূত্রে জানা যায়, পর্যটন শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন- জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৪ শতাংশ অবদান রাখা পর্যটন শিল্পে করোনার আঘাতে গভীর সঙ্কট দেখা দিলেও, তার ৮০ শতাংশ উত্তরণ এরই মধ্যে ঘটেছে। পর্যটন নগরী ও সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার পর্যটকদের জন্য খুলেছে গত ১৭ আগস্ট। এর আগেই খুলেছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। দেশের অন্য দর্শনীয় স্থানগুলোতেও পর্যটকদের সরব উপস্থিতির খবর পাওয়া গেছে। আকাশপথে অধিক যাত্রী পরিবহনের তথ্য মিলেছে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের দেশে-বিদেশে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে।

এবারের ঈদের পর্যটন খাতের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- ভারতে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের ভ্রমণ। করোনা তা-বের বিধিনিষেধ সব উঠে যাওয়ায় ভ্রমণপ্রেমীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে। যেমন ভিসার চাপ তেমন ইস্যুও করা হচ্ছে। তাদের মতে, দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর দেশে ভারতের ভিসা সেন্টারগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। বিভিন্ন সূত্রের দেয়া তথ্য হচ্ছে- এই ঈদের ছুটিতে কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ ভারতে বেড়াতে যাবেন। কেননা, গত ২ বছর ভারতে পর্যটন ভিসা বন্ধ ছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে ভিসা দেয়া শুরু করেছে। এবার নানা কারণে ঈদের সময়ে ৯ দিন টানা ছুটি কাটানোর সুযোগ আছে। ফলে অনেকেই লম্বা ছুটিতে দেশের বাইরে বেড়াতে যেতে আগ্রহী। সহজে ভিসাপ্রাপ্তি, কম সময়ে যাওয়া-আসা, অল্প খরচের কারণে অনেকের প্রথম পছন্দ ভারত। গত দুই সপ্তাহ ধরে ভিসা আবেদনকারীদের চাপ বেড়েছে ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলোতে। অনেককে রাত থেকে লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে। চাপ সামলাতে জনবল ও অফিস সময় বাড়িয়েছে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র। বন্ধের দিনগুলোতেও ভিসা আবেদনকারীদের জন্য কার্যক্রম চালু রেখেছে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র। আগে প্রতিদিন দুপুর ১টা পর্যন্ত ভিসা আবেদন গ্রহণ করা হতো। তবে চাপ বাড়ায় ভিসাকেন্দ্র সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা রাখা হচ্ছে। কাউন্টারে জনবল বাড়ানো হয়েছে। দেশের অন্যান্য জেলায়ও ভিসা সেন্টারে বাড়তি চাপ রয়েছে। বিমানবন্দরের দিকে তাকালেও দেখা যায়- বেড়েছে ফ্লাইটের সংখ্যাও। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৭টি এয়ারলাইন্স ভারতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এই ৭ এয়ারলাইন্স সপ্তাহে মোট ৫৮টি ফ্লাইটে যাত্রী নিয়ে ভারতে যাচ্ছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পর্যটক গেছেন প্রায় ২২ লাখ। মূলত কম খরচে মানসম্পন্ন চিকিৎসা, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ ও কেনাকাটার জন্য বাংলাদেশীরা ভারতে যান। একই সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা পর্যটনবান্ধব হওয়ায় পর্যটকদের আগ্রহ বেশি। ভারতে চাহিদা বাড়ায় বেড়েছে আকাশপথে ফ্লাইটের ভাড়া। অনেকে খরচ কমাতে ভ্রমণ করবেন সড়কপথে। ইতোমধ্যে পর্যটকদের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের হোটেলগুলোর ভাড়াও বেড়েছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন সূত্রে জানা যায়, এখন হাজার হাজার মানুষ ভিসার জন্য প্রতিদিন আবেদন করছেন। এবার ঈদের ছুটিতে ৫ লাখের বেশি মানুষ ভারতে যেতে পারে। অনেকে সিকিম ভুটান ও নেপাল যাাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। বেশি বিত্তবানরা তো মালয়েশিয়া, দুবাই ও ব্যাঙ্কক যাবেনই।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও জাবেদ আহমেদ বলেছেন, করোনা যতই কমে আসুক কিংবা নিয়ন্ত্রণে থাকুক, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কোন ছাড় নেই। প্রতিবেশী ভারতেই এখন ফের বাড়ছে সংক্রমণের সংখ্যা। কাজেই ভয় কিন্তু রয়ে গেছে। সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্য বিধি মানতে হবে। নিয়ম না মানলে পর্যটকদের জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে। কেউ যদি মাস্ক না পরে কোথাও যান, তাহলে তাকে জরিমানা গুনতে হবে। এ জন্য মোবাইল কোর্ট, ট্যুরিস্ট পুলিশ এবং প্রশাসন নজরদারি করছে। পর্যটকদের কোচগুলোতে একটি করে আসন বাদ দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কক্সবাজারে পর্যটকদের কাছে যারা বিভিন্ন সুভেনির বিক্রি করেন, সেখানে যারা গাড়ি সরবরাহ করেন, ট্যুর গাইড, রেস্টুরেন্টের কর্মী তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এমনকি রান্নাঘরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে- সেটিও বলে দেয়া আছে ওই সরকারী নির্দেশাবলিতে। মোট কথা স্বাস্থ্যবিধিতে কোন ছাড় দেয়া হচ্ছে না। হবেও না।

শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা দিলো ওয়ালটন
ঈদের ছুটিতে পর্যটক বরণে প্রস্তুত বান্দরবান

আপনার মতামত লিখুন