শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয়

বদলে যাবে দক্ষিণের দ্বীপ, পর্যটনে নতুন সম্ভাবনা

অনলাইন ডেস্ক
০৮ নভেম্বর ২০২২

দেশের উপকূলীয় বেশ কয়েকটি দ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার এখনো আধুনিকায়ন হয়নি। এবার কয়েকটি দ্বীপে নতুন করে নৌ-যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক কার্গো পরিবহন সহজ ও পণ্য ওঠানামায় গতি আসবে। আর সৌন্দর্যের লীলাভূমি এসব দ্বীপে পর্যটন বিকাশে নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে। যা পাল্টে দিতে পারে এসব এলাকার অর্থনীতি ও জীবনধারা। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাণিজ্যিক নগরী মিরসরাই ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এবং কক্সবাজারের সোনাদিয়া ও টেকনাফে জেটিসহ প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা হবে।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি উত্থাপন করা হবে। এছাড়াও আরও ৫টি পাঁচটি প্রকল্প তুলে ধরা হবে চলতি অর্থবছরের ৬ষ্ঠ এই একনেক সভায়। ‘চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ (সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ) অংশের জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ উপজেলায় এক হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।

প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই ও সন্দ্বীপ অংশে জোটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি, কক্সবাজার জেলার সোনাদিয়া, টেকনাফের সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপে জেটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ করা।

ফলে এসব দ্বীপে পর্যটনের বিকাশে দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। যাত্রীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার পাশাপাশি এবং নৌ-পর্যটন সুবিধাসহ আধুনিক ল্যান্ডিং সুবিধাদি প্রদান করা হবে। এসব এলাকার ক্রমবর্ধমান বাল্ক কার্গো এবং পণ্য ও মালামাল লোডিং-আনলোডিংয়ের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে বাণিজ্যিক গতি বৃদ্ধি করা হবে।

প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সচিব মামুন আল রশীদ বলেন, প্রকল্পটিতে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বীপগুলোতে মানুষের যাতায়াত শুরু হবে। তাছাড়া এসব এলাকায় পণ্যবাহী বড় বড় জাহাজ ভিড়বে। ফলে অর্থনীতি গতিশীল হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে বুয়েটের কর্তৃক সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় বেশ কিছু বড় পরিবর্তনের আশা করা হচ্ছে। জেটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদান করা হলে পরিবহন খাতে দেশের অবদান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া  এসব এলাকার অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক গতিপথও পরিবর্তন হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে-

মিরসরাই ॥ মিরসরাইয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ৩০ হাজার একর জমির ওপর এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি চট্টগ্রাম ঢাকা মহাসড়কের পূর্ব দিকে অবস্থিত। পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল, উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বে ম্যানগ্রোভ বন ও জলাভূমি। আর দক্ষিণে ফেনী নদী অবস্থিত। এটিতে সহজে প্রবেশের জন্য ৫ মিটার প্রস্থ এবং ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘের একটি প্রবেশ পথ নির্মাণ করা হবে। জোয়ার এবং বর্ষাকালে পানি যাতে প্রবেশ না করতে পারে।

সন্দ্বীপ ॥ চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সন্দ্বীপের পূর্ব উপকূল বরাবর তিনটি ফেরিঘাট রয়েছে- মাঝিরহাটঘাট, সন্দ্বীপ পূর্ব এবং গুপ্তছড়া ফেরিঘাট। মীরসরাইতে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হলে অনেক শ্রমিক সন্দ্বীপে বসবাস করবে ও এই দ্বীপ হতে কর্মস্থলে যাতায়াত করবে। এ কারণে উপকূল ও সমুদ্রবর্তী দ্বীপসমূহে ওঠানামার জন্য উন্নত ল্যান্ডিং সুবিধা যুক্ত করা হবে।

সোনাদিয়া ॥ কক্সবাজার থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সোনাদিয়া দ্বীপ অবস্থিত। সোনাদিয়া দ্বীপ শুঁটকি মাছের জন্য বিখ্যাত। সম্ভাব্য পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য জেটিসহ ল্যান্ডিং সুবিধাদির উন্নয়ন করা হবে। ফলে নতুন করে এখানে পর্যটকদের ঢল নামতে পারে। যা নতুন অনেক কর্মসংস্থান তৈরি করবে।

সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ॥ কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় একহাজার ২৭ একর এলাকা জুড়ে কক্সবাজার জেলার প্রথম সম্পূর্ণ পর্যটন পার্ক হিসেবে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক  তৈরি হচ্ছে। পার্কটি এ সৈকতের সামনে অবস্থিত এবং এটি থেকে সাগর পথে প্রবাল দ্বীপ, সেন্টমার্টিন যেতে মাত্র আধঘণ্টা সময় লাগবে। এ কারণে এখানে যাতায়াতের জন্য জোটসহ ল্যান্ডিং সুবিধাদির উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জালিয়ার দ্বীপে জেটি ॥ নাফ নদীর মাঝখানে ছোট্ট একটি দ্বীপ জালিয়ার দ্বীপ। টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নে অবস্থিত জালিয়ার দ্বীপে কোন লোক বসতি নেই। ২৭১ একর জমিতে নাফ ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। পার্কটিতে পর্যটনের সকল আধুনিক সুবিধা থাকবে। এখানে প্রচুর বিদেশী অতিথি আসার চিন্তা করেই সবকিছু সাজানো হচ্ছে। যাতায়াতের জন্য জোটসহ ল্যান্ডিং সুবিধাদি নির্মাণ প্রয়োজন ছিল এখানে।

দ্বীপগুলোতে জেটি নির্মাণের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি (সমুদ্রবিজ্ঞান) বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মুসলেম উদ্দিন মুন্না বলেন, বিশ্বে বিভিন্ন দেশে এমন দ্বীপ এলাকা নিয়ে পর্যটন গড়ে তোলা হয়। তিনি বলেন, সন্দ্বীপের কথাই যদি বলি এটা চারদিকে পানি বেষ্টিত নতুন নতুন চর সমৃদ্ধ দারুণ একটি এলাকা।

সেখানে সবুজ ম্যানগ্রোব বন আছে। কিন্তু শুধুমাত্র যাতায়াত সমস্যার কারণে পর্যটনবান্ধব হয়ে ওঠেনি। থাকা এবং  ভেতরেও যাতায়াতেরও ব্যবস্থা নাই। এখন নতুন করে জেটি নির্মাণ হলে স্থানীয় মানুষের নতুন নতুন ব্যবসা সৃষ্টি হবে। ইকো টুরিজমের প্রসার ঘটবে। তবে সবার আগে পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়েই নির্মাণ কাজ করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন এ পর্যটন বিশেষজ্ঞ।

প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- ১৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে জেটি নির্মাণ। ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ। ৪ লাখ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়নে ব্যয় হবে সোয় তিন কোটি টাকা। ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দর ভবন নির্মাণ করা হবে। খননের জন্য ব্যয় হবে ১৫ কোটি টাকা।

৯৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে পানি নিয়ন্ত্রণ করার কাজে। ৩৯ কোটি টাকায় অভ্যন্তরীণ নির্মাণ কাজ করা হবে। চলতি অর্থবছরে ব্যয় করা হবে ৭৫৫ কোটি টাকা। আর সামনের অর্থবছরে ৬৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনে গত বছরের জুলাই মাসে প্রকল্পটির বিষয়ে মূল্যায়ন কিমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেটি পরিচালনা ও ব্যবহারে বেজার সঙ্গে একটি চুক্তি করতে বলা হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন, ড্রেজিং ও তীররক্ষায় ব্যয় হ্রাসের কথা বলা হয়। হাইড্রেলিক জরিপ, ভবন ভাড়াসহ অন্যান্য বেশ কিছু খাতে ব্যয় হ্রাসের পরামর্শ দেওয়া হয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আশপাশের জেলাসমূহের লোকজনের মালামাল পরিবহন ও যাতায়াত খরচ কমবে এবং সময় বাঁচবে। এছাড়া প্রস্তাবিত বন্দর এলাকায় পরিবাহিত মালামালের সুষ্ঠু ও নিরাপদ ওঠানামা নিশ্চিতকরণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পর্যটনের বিকাশের মাধ্যমে গতি আসবে অর্থনীতিতেও। পরবর্তীতে সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রকল্পটি অনুমোদেনের সুপারিশ করে পরিকল্পনা কমিশন।

আর্থিক চাপে পর্যটন খাতে নতুন সঙ্কটের আভাস
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পঞ্চগড় যাবেন যেভাবে

আপনার মতামত লিখুন