শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ইভেন্ট

মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের

হুমকিতে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য

আবদুল আজিজ
৩০ জানুয়ারি ২০২২

পরিচ্ছন্ন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। কেয়াবন ও প্রবাল থেকে শুরু করে যত্রতত্র বর্জ্যরে কারণে দূষিত হচ্ছে দ্বীপের নীল জলরাশি। হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। এসব দূষণ প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়বে বলে ধারণা করছেন পরিবেশবাদী ও বিজ্ঞানীরা।

স্বচ্ছ নীল জলরাশি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটিতে প্রতি বছর ভ্রমণে আসে হাজারো পর্যটক। পর্যটকদের চাপে দ্বীপের পরিবেশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য নানামুখী আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ জন্য কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। কিন্তু আইনের প্রয়োগ চোখে পড়েনি কোথাও। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিকজাত চিপসের প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, পানির বোতল, পানির প্লাস, ডাবের খোসা, ডাবের পানি খাওয়ার স্ট্র, খাবার প্যাকেট, ভাঙা চশমা বা কাঠি, মাছ ধরার জালের টুকরো, নাইলন দড়ির টুকরোসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্য। এ ছাড়া ছোট-বড় শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁর পাশাপাশি সঙ্গে যোগ হয় গৃহস্থালির বর্জ্য।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রশীদ আহমদ বলেন, ‘দ্বীপকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের কথা আমরা শুনি। কিন্তু বাস্তবে কিছু দেখতে পাই না।’

একই এলাকার আব্দুর রহিম বলেন, ‘প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন বেড়াতে আসেন। এসব পর্যটক কয়েক হাজার কেজি বর্জ্য সৃষ্টি করেন। মাঝেমধ্যে কিছু বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হলেও বেশির ভাগ সময় বর্জ্য গিয়ে মেশে সমুদ্রে।’

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহাম্মদ বলেন, ‘দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসেন। এই দ্বীপে অবস্থিত শতাধিক হোটেল-মোটেলকে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয় যেন তাদের ময়লা-আবর্জনাগুলো ডাস্টবিনে ফেলে। কিন্তু কেউ কারও কথা শোনে না। কেউ কেউ সেই নির্দেশনা মানলেও দেখা যায় অনেকে উদাসীন।’

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কিছু সাইনবোর্ডে লাগানো হয়েছে। তারা পর্যটক এবং স্থানীয়দের স্বার্থে কিছুই করে না।’

সেন্টমার্টিনে দায়িত্বরত পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মী আব্দুল হামিদ বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে না ফেলতে প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু ভ্রমণে আসা পর্যটকরা কোনো কথা পাত্তা দেয় না। এ ছাড়া দ্বীপে দায়িত্বরত প্রশাসন কোনো ধরনের সহযোগিতা করে না।’

ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা প্রকৌশলী পারভিন আক্তার বলেন, ‘দ্বীপের সৌর্ন্দয রক্ষার্থে ময়লা-আবর্জনা প্রতিরোধ করে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তা না হলে দিন দিন দ্বীপের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে এবং দূষিত হতে পারে।’

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘দ্বীপ রক্ষায় একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। কিন্তু কোনোভাবে কাজে আসছে না। দ্বীপের চারদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।’

সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিভিন্ন দূষণের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘অতিরিক্ত পর্যটক ভ্রমণে দ্বীপের নানা রকম বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে দ্বীপ। এ জন্য অন্তত পর্যটন এলাকাগুলোতে পলিথিন ও চিপসের প্যাকেট ব্যবহার বন্ধে সুপারিশ করা হয়েছে।’

এই সমুদ্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘পরিবেশবিরোধী এসব ময়লা-আবর্জনায় হারিয়ে যেতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ। নষ্ট হতে পারে দ্বীপের প্রকৃতি। এমনকি দূষণের কারণে মানচিত্র থেকে হারিয়েও যেতে পারে একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি।’

১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও টেকনাফ সৈকত এলাকাসহ দেশের ৬টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়ে বৃহস্পতিবারও চার রিসোর্টকে সাড়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আমাদের অভিযান নিয়মিতই হয়। তবে পর্যটকদের সতর্ক হতে হবে।’

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেন্টমার্টিন দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭-১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ও ১২০ প্রজাতির পাখি। দ্বীপটির স্বচ্ছ পানিতে নামলে পাথরের স্তূপের ওপর নানা প্রজাতির প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক ও অসংখ্য প্রজাতির মাছ দেখা যায়। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি প্রসিদ্ধ। ভাটার সময় দ্বীপের চারদিকে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল।

এ কারণে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ-তে ৯টি পয়েন্টের নিষিদ্ধ কার্যক্রম রোধ কল্পে) আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, দ্বীপে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা, পর্যটক ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করা, পর্যটকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করা, ছেঁড়াদ্বীপে পর্যটক নিষিদ্ধ করা, দ্বীপে স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, দ্বীপে নিরাপদ খাবার পানির উৎস নিশ্চিত করা, পরিবেশ ছাড়পত্র ব্যতীত হোটেল ও রিসোর্ট তৈরি বন্ধ করা, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য ও দ্বীপ রক্ষায় নীতিমালা তৈরি করাসহ নানান প্রস্তাবনা দিচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

কালের সাক্ষী ময়মনসিংহের নীলকুঠি গ্রাম
ইকোপার্কের ভাঙা সেতু মেরামত করলেন পর্যটকরা

আপনার মতামত লিখুন