শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

সুন্দরবন উপকূলে ফিরে আসুক প্রাণচাঞ্চল্য

আব্দুল্লাহ মুয়াজ
১৮ জুন ২০২০

ঘুর্ণিঝড় সুপার সাইক্লোন আম্পানের পর থেকেই সুন্দরবন উপকূলের প্রায় কয়েক লাখ মানুষ পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন। বিশেষ করে খুলনার কয়রা উপজেলা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি এবং শ্যামনগরের বিশাল অংশ এখন পানির নিচে। ঝড়ের তোড়ে কপোতাক্ষ এবং খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। লোনা পানির তোড়ে কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী, কয়রা সদর এবং মহারাজপুর ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। দীর্ঘদিন যাবত জোয়ার ভাটার কারণে অধিকাংশ ঘরবাড়ি নেই বললেই চলে। একই অবস্থা সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, হাজরাখালী, শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনিসহ বিস্তির্ণ এলাকার। 

এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কয়েক দফা চেষ্টায় কিছু জায়গায় রিং বাঁধ দিয়েছে। সেগুলোও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। পানিবন্দি এসব মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করছেন। ঘরবাড়ি সহায় সম্বল হারিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর টং বানিয়ে কেউবা নৌকায় ভেসে ভেসে দিনাতিপাত করছেন। কেউ সাহায্য করলে খেতে পারে অন্যথায় অনাহারেই দিন পার করতে হয়। নেই স্যানিটেশনের ব্যবস্থা। জোয়ারের পানিতে পরিপূর্ণ থাকে, যে কারণে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ভাটি এবং রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বিশেষ করে মহিলা এবং শিশুরা রয়েছে চরম কষ্টে। সম্প্রতি কয়রা সদর উইনিয়নের দুই নম্বর কয়রা এলাকার পঞ্চাষোর্ধ এক মহিলা আক্ষেপ করে বলেন, 'সারাদিন পানি খাই না। কারণ পানি খেলে বাথরুম লাগে। দিনের বেলা বাথরুম করার কোনো ব্যাবস্থা নেই। সন্ধ্যার পর যখন ভাটিতে পানি কমে যায় তখন এসব কাজ সারতে হয়।' 

এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তারা। এছাড়া যাদের জায়গা জমি আছে তারা চিংড়ি ঘের করে। অনেকে আবার ইঞ্জিন চালিত ভ্যান চালিয়ে, মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবন ধারণ করেন। আম্পানের পর পুরো এলাকা প্লাবিত। নেই মাছের ঘের, নেই রাস্তাঘাট। ঘের ডুবে মাছ নষ্ট হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট পানির নিচে থাকায় ভ্যান চালানোরও জায়গা নেই। ফলে ধনী-গরিব কিংবা উঁচু-নিচু বলতে এখন আর কোনো পার্থক্য নেই। তবে কিছুটা সুবিধা হয়েছে যাদের নৌকা রয়েছে তাদের। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ার পর যে যতটুকু পেরেছে নিজের নৌকাতেই জিনিষপত্র উঠিয়ে নিয়েছে। এখন পানিতে ভেসে বেড়ালেও জোয়ার ভাটার হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পাচ্ছেন তারা।

উপকূলীয় সাদাসোনার এই অঞ্চলের মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে দিন পার করলেও তাদের এখন একটাই দাবি, তা হলো- টেকসই বেড়িবাঁধ। ত্রাণ দিতে যাওয়া অধিকাংশ সংগঠন কিংবা ব্যক্তিদের কাছে এই আবদার করছেন ডুবে থাকা মানুষগুলো। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর দীর্ঘ দশ বছরে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিলেন সুন্দরবন উপকূলের মানুষগুলো। রাস্তাঘাট কেবল চলাফেরার উপযুক্ত হয়ে উঠতেছিল। মাছের ঘেরগুলোতে কেবল সাদাসোনা (চিংড়ি মাছ) চাটি মারা শুরু করেছিল। এরমধ্যেই আম্পানের আঘাত মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার হাজার বিঘা জমির চিংড়ি ঘের এখন পানির নিচে।  

যে মানুষগুলার একদিন নদীতে জাল না ফেললে পেটে ভাত জুটে না, সেই মানুষগুলো এখন ঠায় বসে আছে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে মরিয়া হয়ে ছুটছে। ছোট ছোট শিশুদের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় ক্ষুধার যে কত যন্ত্রণা। বাতাসের তীব্র গতি আর উত্তাল নদীর তীব্র ঢেউ উপেক্ষা করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। বনের ভেতরে বাঘের মুখে বসে থেকেই মাছ শিকার করেন। অথচ ভয়ডরহীন মানষগুলো চুপসে গেছেন আম্পানের তীব্র তাণ্ডবে। পেটের জালা মেটাতে নৌকা দেখলেই সাঁতরে চলে আসে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে মাঝ বয়সী নারী-পুরুষ। কষ্টগুলো একাধিক। একদিকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার, অন্যদিকে ক্ষুধা নিবারণ। কোনটা থেকে কোনটা কম নয়।

পরিশেষে কামনা থাকবে, সুন্দরবন উপকূলে আবারো ফিরে আসুক প্রাণচাঞ্চল্য। এ অঞ্চলের সরল মনের খেটে খাওয়া মানুষগুলো ফিরে পাক ভিটেবাড়ি। আবারো বনে ফিরুক নৌকা নিয়ে। নীল রংয়ের নেটজাল, বড় ফাঁস ওয়ালা জালে (বেনজাল) মাছ ধরা পড়ুক ভরপুর। ফড়িয়ারা (পাইকারী মাছ ক্রেতা) পাতিল নিয়ে ওয়াপদা রাস্তার (বেড়িবাধ) ওপরে দাঁড়িয়ে থাকুক। ছোট ছোট জালে রেণু (বাগদা চিংড়ির বাচ্চা) ধরে ঝিনুকে করে গুনে গুনে সেই মাছগুলো ফঁড়িয়াদের দিয়ে যাক সাধারণ মানুষ।   

লেখক : সাংবাদিক

করোনা রোগীর সেবা দিতে গিয়ে ছেলেসহ আক্রান্ত লড়াকু চিকিৎসক দম্পতি
করোনায় বিপর্যস্ত পর্যটন খাত : আমাদের করণীয়

আপনার মতামত লিখুন