বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

পর্যটনকে কেন এত অবহেলা?

শহিদুল ইসলাম সাগর
১৮ জুন ২০২০

প্রতি বছরের মতো এবারও সংসদে ৪৯তম বাজেট উপস্থাপন করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রভাবে চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির প্রেক্ষাপটে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে মূল প্রত্যাশা ছিল, এই বাজেট যেন অর্থনীতির হাল ধরে রাখতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতে স্বাস্থ্য খাত প্রাধান্য পাবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই সাথে কৃষি, শিক্ষাসহ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেই যে সিংহভাগ বরাদ্দ যাবে সেটাই স্বাভাবিক। এত গুরুত্বপূর্ণ খাতের ভিড়ে অবহেলিত পর্যটন খাত কিইবা আশা করতে পারে। ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন খাতে ৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে তা বেড়েছে মাত্র ২৬২ কোটি টাকা। যা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এরমধ্যে প্রায় ৮০% বাজেট বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। এত বড় পর্যটন খাতের জন্য মাত্র ৭২৫ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। 

গত ১৭ জুন সম্মিলিত পর্যটন জোটের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোখলেছুর রহমানের সঞ্চালনায় সম্মিলিত পর্যটন জোটের উদ্যোগে ‘পর্যটনে বাজেট’ শীর্ষক অনলাইন মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান (পরিকল্পনা) লুবনা ইয়াসমিন, বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের সমন্বয়কারী শফিকুজ্জমান, অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশের (আটাব) সাবেক সভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব, ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) পরিচালক (মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশন) সাহেদ উল্লাহ, ট্যুর অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি রেজাউল করিম রেজা, ময়মনসিংহ ট্যুরিস্ট ক্লাবের সদস্য আবদুল কাদের চৌধুরী মুন্না ও সম্মিলিত পর্যটন জোটের প্রথম যুগ্ম-আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম সাগর, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স এ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুদুল হাসান জায়েদী এবং ডিরেক্টর অপারেশন কিশোর রায়হানসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। এছাড়াও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি টেলিফোনে এই সভায় যুক্ত ছিলেন।

১১ জুনের বাজেট পেশের পূর্বে গত ২১ মে সম্মিলিত পর্যটন জোটের সাথে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বাজেটে ট্যুরিজম রিকভারি ও উন্নয়নে বরাদ্দ নির্ধারণ শীর্ষক এক অনলাইন সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পীরজাদা শহীদুল হারুণ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ। সেই সভায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে পর্যটনকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সম্মিলিত পর্যটন জোট ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রত্যাশা করে। এরমধ্যে পর্যটন রিকভারির জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা এবং পর্যটন উন্নয়নের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাব পেশকালে বলা হয়, ২০১৯ সালে পর্যটন বাংলাদেশের জিডিপিতে ৪.৪% অর্থাৎ ৭৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অবদান রেখেছে, পর্যটন রপ্তানির মাধ্যমে একই বছর ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে এবং এই সেক্টরে বর্তমানে নিয়োজিত আছে প্রায় ৪০ লক্ষ কর্মী। এই কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৯০% প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ। 

বর্তমান বাজেটে নিঃসন্দেহে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বিস্তর ফারাক। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ‘পর্যটন শিল্পকে অর্থনৈতিক খাত হিসেবে উন্নত ও সমৃদ্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার আলোকে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। যেমন, দেশের পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানগুলোতে কেবল বিদেশিদের জন্য স্বতন্ত্র পর্যটন এলাকা স্থাপন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক, দ্বীপভিত্তিক পর্যটন পার্ক ও হোটেল নির্মাণ এবং পর্যটকদের বিনোদনসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।’

বর্তমান বাজেট প্রসঙ্গে জনাব র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি স্বীকার করেন প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের পর্যটন খাতকে অবহেলা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ, সমুদ্র সৈকত এলাকা ও সিলেটের প্রাকৃতিক নিসর্গ ভিত্তিক পর্যটন গড়ে তোলার জন্য এই বাজেট অত্যন্ত অপ্রতুল। তিনি সংসদে পাস হওয়ার পূর্বে মন্ত্রণালয়কে এই বাজেট পুনর্মূল্যায়ন করার পরামর্শ দেবেন বলে জানান।

ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ বলেন, পর্যটন কোনো একক সত্ত্বা নয়, পর্যটনের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নির্ধারিত থাকলেও অন্তত ১৭টি মন্ত্রণালয় মিলে এই সেক্টরের কাজ করতে হয়। কাজেই পর্যটনকে মেইনস্ট্রিমিং করতে হবে যেন অন্যান্য মন্ত্রণালয় তাদের কর্মকাণ্ড ও বাজেট প্রণয়নের সময় পর্যটনকে বিবেচনা করে। তা নাহলে পর্যটনের বাজেট বাড়ালেও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জিত হবে না। এক প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে তিনি অবিলম্বে ট্যুরিজম স্যাটেলাইট একাউন্ট চালুর কার্যক্রম শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেন।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান (পরিকল্পনা) লুবনা ইয়াসমিন বলেন, বাজেট প্রণয়নে মন্ত্রণালয়ের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে তা প্রণীত হয়। যেমন, আগের বছরের ব্যয়িত অর্থের সাথে ১৫% হারে পরের বছরের বাজেট তৈরি হয়। তাই বাজেটের আয়তন হঠাৎ করে বাড়ে না। তাছাড়া পর্যটনের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক বড় দুর্বল, এতে মন্ত্রণালয় পর্যটনের বিষদ কিছু জানে না। তিনি সম্মিলিত পর্যটন জোটকে আশ্বস্ত করে বলেন, আপনাদের সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন প্রস্তাবনা নিয়ে আসুন, আমরা বাস্তবায়ন করবো।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের দেশের আপমর জনগোষ্ঠীর পর্যটন সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তাই এই শিল্পের পশ্চাৎপদতার একক দায় শুধু সরকারের উপর বর্তায় না। পর্যটন ব্যবসায়ীরা যেমন এই শিল্পের গুরুত্ব সরকারকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন আবার পর্যটন সুশীল সমাজ যেমন শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিকগণও তেমন অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন নি। 

তবে আশার বাণী হলো, আগামী কয়েক বছরে নিশ্চিতরূপে এ শিল্পের পরিবর্তন ঘটবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২ নভেম্বর ট্যুরিজম সেক্টরকে এসএমই এবং পুনঃঅর্থায়নযোগ্য খাত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তিতে ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য এক পরিপত্রের মাধ্যমে একে সেবা ও অগ্রাধিকার খাত হিসেবে নির্ধারণ করে। এই পরিপত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত ২৪টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এসএমই খাতের মধ্যে পর্যটন ৫ম স্থানে রয়েছে। তবে পর্যটনের সকল উপখাতগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না করার জন্য ঋণ সুবিধা থেকে ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতে গত ১৪ জুন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবরে একটি প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়। 

এতে পর্যটনখাতে ১০টি উপখাত চিহ্নিত করে তার অধীন ১২৫টি ক্ষেত্রে পর্যটনে এসএমই ঋণদানের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। 

পর্যটনের ১০টি উপখাতগুলো হচ্ছেঃ

উপখাত ১: পর্যটন আবাসন

উপখাত ২: পর্যটন পরিবহণ

উপখাত ৩: খাদ্য ও খাবার

উপখাত ৪: বিনোদন

উপখাত ৫: বিশেষায়িত পর্যটন কার্যক্রম

উপখাত ৬: মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান

উপখাত ৭: পর্যটন শিক্ষা

উপখাত ৮: পর্যটন প্রযুক্তি

উপখাত ৯: পর্যটন প্রকাশনা

উপখাত ১০: বিবিধ

এ ছাড়াও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাথে চুক্তি মোতাবেক মোড-৪ অনুযায়ী পর্যটন ও টেলিকমিউনিকেশনকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (বিপিসি) ও পর্যটন জোটের যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম শুরু হচ্ছে। গঠিত হচ্ছে প্রথম পর্যটন সমবায় সমীতি।

আমাদের দেশে গার্মেন্টস সেক্টরকে প্রধান রপ্তানি শিল্প হিসাবে ধরা হয়, অথচ গার্মেন্টস সেক্টর বছরে ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করলেও ২২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি করে। অন্যদিকে ইউরোপের বাজার পড়ে গেলে গার্মেন্টসও পড়ে যাবে। কিন্তু পর্যটনের রপ্তানি নিট এবং এই বাজার কখনো পড়বে না। পর্যটন রপ্তানির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর আয়ের পুরো টাকাটাই দেশে থাকে। ২০১৯ সালে পর্যটন আমাদের জিডিপিতে ৪.৪% অর্থাৎ ৭৭ হাজার ৩০০ কোটির অবদান রেখেছে, ৪০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং মোট অর্থনীতির ৩%-এর অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করেছে। একই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে পর্যটন রপ্তানি থেকে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন যে, মহামারীকে কাটিয়ে ওঠার জন্য পর্যটন একটি প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। জনগণকে একত্রিত করার মাধ্যমে পর্যটনই পারে সংহতি ও আস্থা বাড়িয়ে তুলতে। তিনি এই মর্মে বিশ্বকে একটি বার্তা প্রেরণ করেছেন যে, জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা পুনরায় পর্যটন শুরু করার মাধ্যমে টেকসই বিকাশের জন্য ২০৩০ এর এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং আমাদের সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সদস্যদের সুরক্ষায় এই খাতটির অনন্য ভূমিকা পালন করবে।

তাই আগামীতে সংহতি ও আস্থা বাড়িয়ে পর্যটন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসাবে গড়ে উঠবে এ প্রত্যাশা সকলের।

লেখক : ১ম যুগ্ন-আহবায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিইএ)

সোনারগাঁয়ের কারুশিল্পীদের মাঝে সুবর্ণগ্রামের স্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণ
সুবর্ণচরের ইউএনও করোনায় আক্রান্ত

আপনার মতামত লিখুন