শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মতামত

বিদেশিরা কি জানে আমাদের পর্যটনের দুয়ার খুলেছে

জাবেদ আহমেদ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২২

বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট পর্যটনবোদ্ধা ও সুলেখক তৌফিক রহমানের একটি নিবন্ধ গত ১৬ জুলাই প্রথম আলোর মতামত কলামে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘বিদেশি পর্যটকদের দরজা খুলবে কবে’। সময়োচিত লেখাটির জন্য প্রথমেই তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।

দেশের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকায় নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ায় দেশের পর্যটনসংশ্লিষ্ট লোকজনের অধিকাংশসহ আমজনতার অনেকেই সেটি পড়েছেন। আমিও পড়েছি এবং কয়েকবার পড়েছি। ফেসবুকে লেখাটি আপলোড করায় বারবার পড়ার সুযোগটি মূলত তৈরি হয়। যতবার পড়েছি, ততবারই নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। কারণ, তৌফিক রহমান তাঁর নিবন্ধে বাংলাদেশের পর্যটনের বন্ধ দুয়ার (বিদেশিদের জন্য) না খোলার বিষয়ে যাঁদের দায়ী করার চেষ্টা করেছেন, আমি তাঁদের দলভুক্ত একজন কুশীলবের দায়িত্ব পালন করেছি ২৭ মাস ধরে। পর্যটনশিল্পের নেতৃত্ব প্রদানকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড’। আমি এই বোর্ডের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ২৭ মাস ধরে থেকে মাত্র তিন মাস আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। অবসরের সময়গুলো আমার পর্যটনভাবনা নিয়েই কাটে। 

করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্বের পর্যটনশিল্প একবারেই লন্ডভন্ড হয়ে যায়। লাখ লাখ পর্যটনকর্মী কাজ হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পও করোনার আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়ে। করোনার প্রকোপ কমার সঙ্গে সঙ্গে জীবন-জীবিকার তাগিদে অর্থনীতির অন্য খাতগুলো ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করলে পর্যটন খাত থেকেও সেটিকে খুলে দেওয়ার জন্য দাবি উঠতে থাকে। কিন্তু এ শিল্পের চরিত্র কোভিড প্রটোকলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সাধারণের স্বাস্থ্যচিন্তা থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষ এ দাবি তেমন আমলে নেয়নি। এ কারণে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প দীর্ঘ সময় বিধিনিষেধের আওতাতেই থেকে যায়। সে সময় পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের পর্যটনশিল্পের গতিপ্রকৃতির দিকে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড লক্ষ রাখছিল। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ইউএনডব্লিউটিও ও প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পিএটিএ) কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন ধরনের অনলাইন সভা-সেমিনারে অন্য সব সদস্যরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশও গুরুত্বের সঙ্গে সেগুলোয় অংশগ্রহণ করতে থাকে। এসব সভা-সেমিনারে নিজ নিজ দেশের কোভিড প্রটোকল মেনে অভ্যন্তরীণ পর্যটন খুলে দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছিল।

সীমিত পরিসরে দেশের পর্যটনশিল্প পুনরায় চালু করার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এ খাতে অন্যান্য অংশীজনের সহযোগিতায় করোনা চলাকালে কীভাবে হোটেল-মোটেল পরিচালনা করা হবে, কীভাবে পর্যটন পরিবহন পরিচালিত হবে, অ্যামিউজমেন্ট পার্কগুলো কীভাবে চলবে, সর্বোপরি পর্যটকদের কী দায়িত্ব হবে, সে বিষয়ে পৃথক পৃথক স্ট্যান্ডার্ড অপারেটর প্রসিডিউর (এসওপি) তৈরি করে তা পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় বিলি করে। এসব এসওপি প্রতিপালন সাপেক্ষে ধীরে ধীরে পর্যটনকেন্দ্রগুলোও খুলতে থাকে। করোনার কারণে দীর্ঘ সময় পর মানুষ একটু সুযোগ পেয়েই পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় ভিড় করতে থাকে। অল্প দিনের মধ্যেই দেশের বড় পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় অবস্থিত হোটেল-মোটেলগুলো পর্যটকে ভরে যায়। প্রাণচাঞ্চল্যে আবারও মুখর হয়ে ওঠে দেশের সব পর্যটনকেন্দ্র। করোনা চলাকালে লং হল ট্যুরিজম বন্ধ থাকায় দেশে থাকা ধনী পর্যটকেরা দেশের অভ্যন্তরেই বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে যাওয়া শুরু করেন।

বিআইডিএসের জরিপমতে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটিতে পৌঁছায়। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য কক্সবাজারে এক দিনে চার লাখ পর্যটক সমাগমের রেকর্ডও সৃষ্টি হয়। এসবই দেশীয় পর্যটক। সে সময় বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা ছিল না বললেই চলে। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের কৌশল নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে দফায় দফায় সভা করে। এসব সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আশপাশের দেশগুলোয় যেভাবে বিদেশি পর্যটকদের জন্য দুয়ার খোলা হচ্ছে, আমরাও সেদিকে যাব। আমরাও একটি দিনক্ষণ নির্ধারণ করে বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো বিদেশি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নেব। ট্যুরিজম বোর্ড থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি গেল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে। যত দূর জানি, মন্ত্রণালয় থেকে সে পত্র সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছ যথাসময়ে পাঠানো হয়েছে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভিনদেশি পর্যটকদের মাধ্যমে দেশে-বিদেশি মুদ্রার আগমন ঘটে। ডলার-সংকটের এ সময়ে বিদেশি পর্যটকদের মাধ্যমে আসা ডলার অর্থনীতিতে কাজে আসতে পারত। আরেকটি কথা, যা উল্লেখ না করলেই নয়, সেটি হচ্ছে, প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পিএটিএ) ও ইউনাইটেড নেশন ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অর্গানাইজেশন (ইউএনডব্লিউটিও) বিশ্ব পর্যটনের মোড়ল। বাংলাদেশেও এ দুই সংগঠনেরই সদস্য। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দুটি সংগঠনের অনুকূলে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। খুব সম্প্রতি পিএটিএ তাদের ওয়েবসাইটে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কোভিড–পরবর্তী পর্যটন পরিস্থিতি নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করেছে এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ করছে। এ তথ্যগুলোর মধ্যে দেশের নাম, দেশটির লকডাউন পরিস্থিতি, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের বিষয়ে দেশটির অবস্থান, ওই দেশের কোভিডের টিকা প্রদান-সম্পর্কিত তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে এবং এ তথ্য ছকের মাধ্যমে পর্যটকেরা একটি দেশের কোভিড–পরবর্তী পর্যটন পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাচ্ছেন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, পিএটিএ প্রকাশিত এ তথ্যছকে আমাদের আশপাশের সব দেশের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আমাদের কোনো তথ্য সেখানে নেই। কাজেই বিশ্বের মানুষ জানছে না যে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের দেশ বাংলাদেশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত কি না? সুখের কথা হলো, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ ১৫ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি দেশের পর্যটকদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা চালু করেছে।

বাংলাদেশের পর্যটন বিদেশিদের জন্য খোলা হলো ঠিকই, কিন্তু ট্যুরিজম বোর্ড যেটি চেয়েছিল—বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশের দুয়ার খোলার আগে একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করে অন্তত এক মাস ধরে প্রচার করতে—কিন্তু সেটা আর করার সুযোগ হলো না। খোলার এক মাস আগে থেকে প্রচার করতে থাকলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকেরা আমাদের অবস্থান জানতে পারতেন বলে আমার বিশ্বাস। পিএটিএ বা অন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ফলাও করে এ খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করতে পারত। কারণ, পর্যটনশিল্পে ব্র্যান্ডিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশি-বিদেশি ট্যুর অপারেটররা বাংলাদেশে তাদের পর্যটকদের জন্য ট্যুর আইটিনারি তৈরি করতে পারতেন। এসব উদ্যোগ নিতে পারলে আমাদের দেশে বেশিসংখ্যক বিদেশি পর্যটক পাওয়া যেত। এতে আমাদের পর্যটনশিল্প উপকৃত হতো, উপরন্তু লাভবান হতো আমাদের অর্থনীতি।

যা–ই হোক, সুযোগ এখনো হাতছাড়া হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাদের পর্যটন আকর্ষণগুলো নান্দনিকভাবে তুলে ধরবে, দেশের সেরা হোটেলগুলো বিদেশিদের জন্য নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা দেবে। বাংলাদেশ বিমানসহ, বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলোও বিদেশি পর্যটকদের জন্য ‘স্পেশাল অফার’ দিতে পারে। এসব ব্যবস্থা একসঙ্গে করতে পারলে বিদেশিদের জন্য বাংলাদেশের দুয়ারটা ভালোভাবেই খুলবে বলে আশা করি।

জাবেদ আহমেদ, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সাবেক সিইও।

দুর্গাপূজা উপলক্ষে ১০ দিনের ভ্রমণ প্যাকেজ নিয়ে এলো পশ্চিমবঙ্গ সরকার
শ্রীলঙ্কার পর্যটন স্বাভাবিক, বাংলাদেশিদের আমন্ত্রণ রাষ্ট্রদূতের

আপনার মতামত লিখুন