শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

এ দেশে পর্যটন কি ‘গলাকাটা ব্যবসা’ হয়ে উঠছে

রাফসান গালিব
২২ অক্টোবর ২০২২

মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘোরাঘুরি বলতে একসময় বুঝত ‘পিকনিক’। বছর শেষে, বিশেষ করে শীতকালে সবেধন নীলমণি নীল পানির সাম্রাজ্য কক্সবাজার সমুদ্রে ছুটে যাওয়া। গত দেড়-দুই দশক আগেও বিষয়টি এমনই ছিল। তথ্যপ্রযুক্তি ও অনলাইন দুনিয়ার প্রসারে সেই পিকনিক চকমকে মোড়কে হয়ে গেল—চলো, একটা ট্যুর দিয়ে আসি। 

ঘোরাঘুরি মানে টাকা নষ্ট, এমন ধারণা থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালির বের হয়ে আসার মধ্য দিয়ে আমরা দেখলাম, পর্যটন নামে একটি শিল্প গড়ে উঠল। বছরে এখন হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্বই আসে এ শিল্প থেকে। 

গত বছর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা। যেটি আরও কয়েক গুণ হওয়ার সুযোগ ছিল বা আছে। সেটি কেন হয় না, তা বলতেই এ লেখা।

অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যবিত্তের বিশাল একটি অংশ আর্থিকভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে বললে অসত্য হবে না। সেটি যে করেই হোক না কেন, লাখপতি বা কোটিপতি এখন ভূরি ভূরি। এই পরিবর্তনই পর্যটনশিল্পের বৃদ্ধির পেছনে বিশাল একটি ভূমিকা রেখেছে বলা যায়। গত এক দশকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এখন সাপ্তাহিক ছুটিতে বা এর সঙ্গে বাড়তি এক-দুই দিনের ছুটি পেলেই পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে যেতে মানুষের প্রাণ করে হায় হায়। শহুরে যান্ত্রিক জীবন ও কর্মব্যস্ততায় দুই দণ্ড শান্তি পেতে মানুষ প্রকৃতির পানে ছুটছেন। এবার দুর্গাপূজা, সাপ্তাহিক ছুটি, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও প্রবারণা পূর্ণিমা মিলিয়ে টানা কয়েক দিনের ছুটিতেও তেমনটি আমরা দেখতে পাই।

২.

বাংলাদেশে এখনো পর্যটকদের প্রথম পছন্দ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। এবারের ছুটিতেও কয়েক লাখ পর্যটকের ভিড়ে মুখর ছিল কক্সবাজার। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রসৈকতে দাঁড়ানোর ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে’ অবস্থা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যরসও করেন কেউ কেউ—পর্যটকদের ভারে কক্সবাজার দুই ইঞ্চি দেবে গেছে। এমন দৃশ্য যদিও অপরিচিত নয়। একই অবস্থা দেখা যায় গত এক দশকে বাংলাদেশের পর্যটনের ‘পোস্টার বয়’ হয়ে ওঠা রাঙামাটির সাজেকেও। হাওররাজ্য সুনামগঞ্জে জল আর নীলের মিতালিতেও আশ্রয় পাততে দেখি বিপুল পর্যটককে। অতিরিক্ত পর্যটকের ভিড়ের কারণে বাড়তি হোটেলভাড়া, হোটেলে জায়গা না পেয়ে রাস্তায় অবস্থান, খাবারের আকাশচুম্বী দাম, খাবারের সংকট, স্থানীয় যানবাহনে ভোগান্তি ও বিড়ম্বনা—সবকিছুই এবারও ছিল বরাবরের মতো।

একই সময়ে সাত মাস পর খোলে সেন্ট মার্টিনের দুয়ারও। মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি চলায় নিরাপত্তার কারণে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে জাহাজভ্রমণ বন্ধ রাখা হয়। পর্যটক নিয়ে কক্সবাজার থেকেই সেন্ট মার্টিনে রওনা দেয় জাহাজ। তবে প্রথম যাত্রাতেই জাহাজের এসি নষ্ট থাকাসহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে অনেক পর্যটকই অসুস্থ হয়ে যান। ফিরতি যাত্রায় সেই জাহাজই বর্জন করেন বেশির ভাগ পর্যটক।

আবার একই সময়ে আমরা দেখতে পাই, পর্যটকদের ফেলা প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট, পলিথিন কীভাবে সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওরকে দূষিত করছে। হাওরের পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও তা তেমন মানা হয় না। ফলে হাওরের পানিতেই বর্জ্য ফেলছেন বেশির ভাগ পর্যটক। এর কারণে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সেখানকার কৃষকদের। পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর সেখানে ফসলের আবাদ হয়। এখন এসব প্লাস্টিক বর্জ্য পানিতে না পচে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অক্ষত থাকায় ভুক্তভোগী হচ্ছেন কৃষকেরা। এ ছাড়া শব্দদূষণ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার অবাধ চলাচলে হাওরে নষ্ট হচ্ছে মাছের বিচরণক্ষেত্র, কমছে পাখিও। হাওরে আগের মতো পাখি দেখা যায় না বললেই চলে।

পরিবার নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া একসময় বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্য ছিল কল্পনাতীত। গত এক–দেড় দশকে আমরা দেখি, পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়ারও অভ্যাস তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে। যেমন একই সময়ে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ৯ সদস্য নিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার বেড়াতে যান এক পর্যটক। পারিবারিক এ আনন্দঘন ভ্রমণ পরদিনই পরিণত হয় বেদনাদায়কে। পরদিন সমুদ্রে গোসল করতে নেমে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গিয়ে মৃত্যু হয় ওই পর্যটকের। পর্যটনকেন্দ্র থেকে লাশ নিয়েই ফিরতে হলো পরিবারটিকে। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই কুমিল্লা থেকে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে গিয়ে সমুদ্রে গোসল করতে নেমে এক শিক্ষার্থীর একই পরিণতি আমরা দেখি।

এবার ছুটি থেকে ফেরত এসে এক সহকর্মীর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি। তিনি গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের এক রিসোর্টে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে। দুজন থাকার জন্য একটি রুমে এক রাত তাঁর থাকার খরচ পড়েছে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতি বেলা খাওয়া বাবদ আলাদা প্রত্যেকের ৫০০ টাকা। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত টাকা নিয়ে নিল অথচ এক জোড়া প্লাস্টিকের স্যান্ডেল বা একটি টুথপেস্টই দিল না। পর্যটনকে রীতিমতো গলাকাটা ব্যবসা বানিয়ে ফেলল এরা।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে নিশ্চয়ই। এক বিদেশি নারী পর্যটক কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সানবাথ করছেন, তাঁকে ঘিরে আছে উৎসুক মানুষ। ওই পর্যটক নিজেই এ ছবি পোস্ট করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকতের টানে ছুটে আসা বিদেশি পর্যটকদের এমন বিড়ম্বনার দৃশ্য যদিও নতুন নয়। বরং ধর্ষণের মতো ঘটনাও এখানে ঘটেছে।

৩.

বাংলাদেশের মতো আর কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশে এতটা সমন্বয়হীন পর্যটনসেবা আছে বলে মনে হয় না। একই সময়ে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ পর্যটক একটি পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরতে যায়, তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমন পরিস্থিতিতে বিড়ম্বনা, ভোগান্তি বা নিরাপত্তাহীনতার শিকার হওয়াই তো পর্যটকদের নিয়তি। অতিরিক্ত পর্যটকের প্রবেশাধিকারের কারণে সেন্ট মার্টিন বা লাউয়াছড়ার মতো অনেক পর্যটনকেন্দ্রের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। একসময় সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যাপস চালু করা হলেও সেটির কোনো কার্যকারিতা নেই। সেখানে কোনো ধরনের হোটেল বা রিসোর্ট গড়ে তোলার ব্যাপারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কয় দিন আগেও নতুন করে ভবন  খবর আমরা পাই সংবাদমাধ্যম থেকে। অনেক পর্যটনকেন্দ্রে নিয়ম লঙ্ঘন করে ইজারাদারেরা অতিরিক্ত পর্যটকের প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করে ফেলছেন। সেসব দেখার কেউ নেই যেন। 

কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, পতেঙ্গাসহ আরও যত সমুদ্রসৈকত আছে, কোনোটাতেই পর্যটকের গোসল করার মতো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যার কারণে শুধু কক্সবাজারেই গত দেড় যুগে আমরা ১২৫ জনের বেশি পর্যটকের মৃত্যু দেখি। পর্যটনবান্ধব অন্যান্য দেশের সমুদ্রসৈকতগুলোতে একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা সুইমিং জোন থাকে, পর্যটকেরা সেখানে যাতে নিরাপদে গোসল করতে পারেন। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশে গিয়ে সেসব সুইমিং জোনে নিরাপদে জলকেলিতে মেতে ওঠেন ঠিকই, কিন্তু দেশে তেমন ব্যবস্থা করার চিন্তাই করতে পারেন না।

ইজারাদারদের খামখেয়ালির কারণে সীতাকুণ্ডে ঝরনাগুলোতে প্রতি বছর কোনো না কোনো পর্যটকের মৃত্যু আমরা দেখি। এখানে পর্যটকের অবহেলার কথাও অবশ্যই বলতে হয়। সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ের পাহাড়ি ঝরনা, হ্রদ ও সমুদ্র সৈকত পর্যটকদের জন্য বড় আকর্ষণ এখন। ক্যাম্পিংয়ের জন্য তরুণদের বেশ পছন্দও সেখানকার এলাকাগুলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে প্রায়ই ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয় পর্যটকদের। বিষয়টি অনেকটা নিয়মেই পরিণত হয়েছে বলা যায়। 

পর্যটনের নামে এ দেশে একের পর এক ইকোপার্ক বা সাফারি পার্ক গড়ে উঠছে। সেখানে মূলত কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ ও কিছু বিনোদনমূলক ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। আর ইকোট্যুরিজম নামে যা গড়ে উঠছে, তার সঙ্গে স্থানীয় কমিউনিটি বা বাসিন্দা বা প্রকৃতির কোনো সংযোগ নেই বললেই চলে। ভ্রমণপিপাসুদেরই আবিষ্কার করা ও জনপ্রিয় করে তোলা কোনো পর্যটনকেন্দ্র দিন শেষে সরকারি কর্তৃপক্ষ বা ইজারাদারদের হাতে পড়ে তার স্বকীয়তা নষ্ট হওয়ার অজস্র ঘটনা আছে এ দেশে। বান্দরবানের গহিনে থানচি এলাকায় অনিন্দ্য সৌন্দর্য নাফাখুমের ওপর ঝুলন্ত সেতু বানানো তার একটি বড় উদাহরণ হতে পারে। 

একইভাবে ইকোট্যুরিজমের বিষয়টিও দেশীয় পর্যটকদের কাছে পরিষ্কার নয়। ফলে প্রকৃতির কাছে গিয়ে প্রকৃতিরই ক্ষতি করে আসেন তাঁরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পর্যটকদের অযাচিত আচরণ ও অপর্যটকসুলভ মনোভাবের কারণে সেখানকার বাসিন্দারাই বরং উল্টো বিড়ম্বনায় পড়েন। অন্য দেশগুলো নানা নীতির মাধ্যমে ইকোট্যুরিজমের প্রতি পর্যটকদের অভ্যস্ত করে তোলে, সেটি এখানে দেখা যায় না। যেমন ভারতেরই কোনো কোনো পর্যটনকেন্দ্রে দেখা যায়, সেখানে কোনো পানির বোতল কিনতে গেলে বাড়তি মূল্য দিয়ে কিনতে হয়, পরে ফেরার সময় খালি বোতল ফেরত দিলে সেই বাড়তি মূল্য ফেরত দেওয়া হয়। যেটাকে বলা হয় পলিউটার পে প্রিন্সিপাল। মানে যে পরিবেশ দূষণ করবে, তাকেই এর মূল্য বহন করতে হবে। পর্যটককে শাস্তির ভয় না দেখিয়ে তাঁকে পর্যটনবান্ধব করে তোলাটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। 

এটি অনস্বীকার্য যে এ দেশের পর্যটন এগিয়ে যাচ্ছে বেসরকারিভাবে। অনেক পর্যটক বা ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ঘুরতে ঘুরতে পর্যটনেই নিজেদের পেশাজীবন খুঁজে নিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন ট্যুর অপারেটর। অল্পস্বল্প বা যৌথ বিনিয়োগ নিয়ে ছোটোখাটো রিসোর্ট বা হাউজবোট চালুর উদ্যোগ নিয়েও তাঁরা চমকে দিচ্ছেন। বলা যায়, তাঁদের কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ পর্যটনের সেবা পাচ্ছেন। কিন্তু প্রশাসনিক ও অঞ্চলগতভাবে এবং স্থানীয় বাসিন্দারা পর্যটনবান্ধব না হওয়ায় পর্যটক নিয়ে গিয়ে নানা অসুবিধায় পড়তে হয় ট্যুর অপারেটরদের। এতে তাঁরা এবং পর্যটক উভয়ই ভোগান্তির শিকার হন। আবার ট্যুর অপারেটরদের অপেশাদারি মনোভাবের কারণেও ভুক্তভোগী হন পর্যটকেরা। 

এক আড্ডায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আহসান খালিদ বলছিলেন, এখানে ফেসবুকে একটি পেজ বা একটি ওয়েবসাইট খুলে একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়ে যে কেউ ট্যুর অপারেটর বনে যেতে পারেন। কী কী শর্তে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ট্যুর অপারেটর হতে পারে, সেসব নিশ্চিত করতে কোনো আইনি কাঠামো বা তা তদারক করার সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে কোনো জবাবদিহিও নেই। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় এখানে পর্যটনের যে বাড়তি খরচ, তার একটি কারণ হচ্ছে অনেক ট্যুর অপারেটরের স্বেচ্ছাচারিতা। তারা একেকজন ইচ্ছেমতো ট্যুর খরচ নির্ধারণ করে, যে সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, অনেক সময় তা-ও পালন করে না। ট্যুর অপারেটরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া বলতেও এখানে কিছু নেই। বাংলাদেশের এমন অনেক জায়গা আছে, বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া ট্যুরিস্টদের নিয়ে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ট্যুর অপারেট করা নিয়ে একটি নীতিমালা বা আইন থাকা দরকার। সরকারিভাবে সেখানে রেটিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে পারে, কারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সেবা দিচ্ছে।

সরকার নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে পর্যটনখাতকে এগিয়ে নিতে। এর মধ্যে একটি পর্যটন বোর্ডও করা হয়েছে। পর্যটন নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজও চলছে। তবে মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গদের ভাষ্য হচ্ছে, দেশকে পর্যটনবান্ধব করতে হলে অন্তত ২০–২২টি সরকারি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর যেমন যেমন, নৌপথের পর্যটনের জন্য নৌ মন্ত্রণালয়, সুন্দরবনে বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় প্রয়োজন। এখন পর্যটন মন্ত্রণালয়কে কেউ গুরুত্ব দিতে চায় না। তাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মনোযোগ ছাড়া নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটনবান্ধব দেশ হওয়া বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব। পর্যটন নিয়ে নানা নীতি বা মাস্টারপ্ল্যান এখানে কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।  

৪.

পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাব অনুযায়ী, বছরে এক কোটি দেশি পর্যটক দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র তিন থেকে পাঁচ লাখ। তাদের মতে, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নাগরিকদের পর্যটনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করছে। আর ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখ। তবে ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, এয়ারলাইনস, পর্যটক পরিবহন, ক্রুজিং ও গাইডিং-সংশ্লিষ্ট অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। করোনাকালে বড় ধরনের ধাক্কা খায় এ খাত। টোয়াবের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এ ক্ষতি প্রায় ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকার। পর্যটনবান্ধব দেশগুলো যে পরিমাণ আর্থিক প্রণোদনা বা সহায়তা দিয়ে এগিয়ে আসে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা একেবারে নগণ্যই বলা যায়।


এবার আসি বিদেশি পর্যটকের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে দেশে আগত পর্যটকদের মাধ্যমে আয় হয়েছে ২ হাজার ২৭৯ কোটি টাকার কিছু বেশি, যা ২০২০ সালে (১০ মাস) ছিল ১ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। তবে দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে শুধু পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসেন মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ বিদেশি। এর বাইরে বিদেশ থেকে আগত বলতে অনাবাসী বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট ভিসায় দেশে কাজ করেন, এমন বিদেশি এবং কাজের উদ্দেশ্যে আসা পর্যটক। বিদেশি পর্যটক আগমনের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলোর পর্যটন নিয়ে র‌্যাঙ্কিং করে মুন্ডি ইনডেক্স। এ বছর সংস্থাটির প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনশিল্পে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম আর এশিয়ার ৪৬টি দেশের মধ্যে ৪২তম। র‌্যাঙ্কিংয়ে এমন তলানিতে থেকেও যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়, এগিয়ে থাকলে সেটি যে অনেক গুণ হতো, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বাংলাদেশ কেন বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করতে পারছে না, এ প্রসঙ্গে প্যাসিফিক এশিয়া ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল তৌফিক রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৬৭টি দেশের নাগরিকদের অনঅ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসেরা বিষয়টি অতটা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেন না। ফলে অনেকে এ ব্যাপারে জানেনও না। তা ছাড়া অনঅ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে কেউ এলেও তাঁকে ঢাকা বিমানবন্দরে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এতে দ্বিতীয়বার কেউ এখানে আসতে চাইবেন না। আর দূতাবাসগুলোতে বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে তেমন কোনো প্রচারণা নেই। আর বিমানবন্দরে আমরা নিজেরাই যে ভোগান্তিতে পড়ি, সেটি বিদেশিদের জন্য আরও বেশি অসহনীয়। সেখানেও পর্যটন নিয়ে কোনো ডেস্ক, সেবা বা দিকনির্দেশনা নেই। এখানে থাকার হোটেল ও খাবারেও খরচ বেশি, আবার স্বাস্থ্যকরও নয়। নেপাল বা থাইল্যান্ডে ৬০-৭০ ডলারে মোটামুটি মানের ভালো হোটেল পাওয়া যায়, আর ঢাকায় সেটি ১০০-২০০ ডলার। এখানকার হোটেলগুলো পর্যটকবান্ধব নয়, সেগুলো মূলত ব্যবসায়ী বা সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তাবান্ধব, যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ খরচ তাঁদের বহন করতে হয় না। ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে যাঁরা আসেন, খরচ বেড়ে গেলেও তাঁদের হয়তো তেমন একটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। তবে যাঁরা একা একা বা নিজে নিজে ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন, যেভাবে তাঁরা নেপাল, ভুটান, এমনকি ভারতেও সহজে ঘুরতে পারেন, সেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খুবই কঠিন বলা যায়।

নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র হয়েছে, পর্যটকও বেড়েছে, হোটেল–রিসোর্টের সংখ্যাও বেড়েছে, সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে; একই সঙ্গে বেড়েছে খরচও, কিন্তু বাড়েনি সেবার মান ও অন্য সুযোগ-সুবিধা। ফলে নিরাপত্তা ও স্বস্তি নিয়ে ঘুরতে অনেক মানুষ এখন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটানসহ মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের দিকেই ছুটছেন। পর্যটন ব্যবসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই জানাচ্ছেন, শুধু ভারতেই বাংলাদেশ থেকে বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ ঘুরতে যান। অন্যান্য দেশে ঘুরতে গিয়ে থাকা-খাওয়া ও চলাফেরার খরচ তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ থেকে কম, সেটিই এখন সত্য। সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা, পরিকল্পনা ও সমন্বয় না থাকার কারণে এ দেশের পর্যটনের স্লোগান যেন হয়ে গেছে, ‘পাইছি ট্যুরিস্ট, কামাইয়া লই!’ ফলে একদেশীয় পর্যটক যত বাড়ছে, বাড়ছে না বিদেশি পর্যটক; বরং দেশীয়দেরই বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। কাগজ-কলমসর্বস্ব নীতির কারণে পর্যটন হয়ে গেছে এ দেশের গলাকাটা। মানে লাভের চেয়ে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিই এখানে বেশি বললে অযৌক্তিক হবে না।

রাফসান গালিব, প্রথম আলোর সহসম্পাদক

হোটেল কক্ষ থেকে হাউসবোট সবই লাগামহীন রিকুইজিশনে
ওয়ালটন হেডকোয়ার্টার পরিদর্শনে মুগ্ধ এটিপিএফের প্রতিনিধি দল

আপনার মতামত লিখুন