শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয়

হোটেল কক্ষ থেকে হাউসবোট সবই লাগামহীন রিকুইজিশনে

অনলাইন ডেস্ক
২২ অক্টোবর ২০২২

দেশের পর্যটনশিল্পে রিকুইজিশন (অধিযাচন) নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, পর্যটকদের জন্য বুকিং দেওয়ার পরও হোটেল-মোটেল-রিসোর্টের কক্ষ, যানবাহন, জাহাজ, নৌকা, হাউসবোট ইত্যাদি হুটহাট রিকুইজিশনের নামে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করছেন পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। যদিও সরকারি কাজের প্রয়োজনেই শুধু রিকুইজিশনের বিধান রয়েছে।

পর্যটন মৌসুমে রিকুইজিশনের এসব ঘটনায় পর্যটকরা যেমন বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন, তেমনি ব্যবসায়ীরাও অনাকাঙ্ক্ষিত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে ভাবমূর্তি খোয়াচ্ছেন। একই সঙ্গে গুনতে হচ্ছে আর্থিক মাসুল।

সরকারি কাজের বাইরে হুট করে এই রিকুইজিশন বিড়ম্বনায় হতাশ ও উদ্বিগ্ন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। পর্যটন মৌসুম ও ছুটির দিনগুলোতে হোটেল-মোটেল কক্ষ, জাহাজ, নৌকা, গাড়ি ইত্যাদি রিকুইজিশনের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানিয়েছেন তারা।

পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময়টা পর্যটন মৌসুম। হাওর অঞ্চলে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত থাকে এটি। এ ছাড়া শুক্র ও শনিবারের আগে বা পরে সরকারি ছুটির দিন হলে পর্যটকদের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তারা বলছেন, এমন পর্যটন অনুকূল পরিবেশে রিকুইজিশনের মতো অনভিপ্রেত ঘটনা আকস্মিক বাধা সৃষ্টি করছে। এতে তারা ব্যাবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

প্রশাসনের লাগামহীন রিকুইজিশন নিয়ে সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে পর্যটন খাতের শীর্ষ তিন সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব), বাংলাদেশ ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন (বিডি ইনবাউন্ড) এবং ট্যুরিজম ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিডাব)।

এ ব্যাপারে বিডি ইনবাউন্ডের সভাপতি রেজাউল একরাম বলেন, ‘এমন ঘটনাও ঘটছে যে আগামীকাল ভ্রমণ রয়েছে, বুকিং হয়ে সব ঠিকঠাক, অতিথি ভ্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে রওনাও দিয়েছেন, এমন সময় রিকুইজিশনের মধ্যে পড়ে গেল গাড়ি। এ পরিস্থিতিতে পর্যটকরা মারমুখি হয়ে ওঠেন ট্যুর অপারেটরের ওপর। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করাও কঠিন হয়ে যায়। রিকুইজিশন নেওয়ার ক্ষেত্রে জনস্বার্থের কথা বলা হলেও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এটা করছেন ব্যক্তিস্বার্থে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। ’

টিডাবের চেয়ারম্যান সৈয়দ হাবিব আলী বলেন, “৭ অক্টোবর সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ‘হাওর যাত্রিক’ নামের হাউসবোটটি রিকুইজিশন নেওয়া হয়। হাউসবোটটি এর আগেই ৮ অক্টোবরের জন্য সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের (কাস্টমস অ্যান্ড এক্সসাইজ) পক্ষ থেকে ভাড়া করা হয়। বিষয়টি পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হলেও কোনো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বিষয়টির সমাধান হয়নি। শেষে অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে রাতে হাউসবোটটি অবমুক্ত করা হয়। ”

টিডাবের চেয়ারম্যান বলেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীরা যখন জোটবদ্ধ হয়ে পর্যটন ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখে নিজেরা বাঁচার চেষ্টা চালাচ্ছেন, এমন সময় এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড পুরো পর্যটন ব্যবসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আর না ঘটে এ জন্য সব জেলা প্রশাসন, পুলিশসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থাকে পর্যটকবাহী যানবাহন, জলযান, আকাশযান ও সব পর্যটক আবাসন রিকুইজিশন না করার নির্দেশনা প্রদানের জোরালো দাবি জানাচ্ছি। ’

১০ অক্টোবর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন বরাবর চিঠি দিয়ে হোটেল-মোটেল-রিসোর্টের রুম, জাহাজ, নৌকা, গাড়ি ইত্যাদি রিকুইজিশন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন টোয়াব সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পর্যটন মৌসুমনির্ভর। সাধারণত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময়কে পর্যটন মৌসুম ধরা হয়। হাওরাঞ্চলে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময় পর্যটন মৌসুম হিসেবে বিবেচিত। এই চার মাসের আয় দিয়ে পুরো বছরের খরচ মেটাতে হয়। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকরা ভ্রমণ করে থাকেন। ওই দুই দিনের আগে বা পরে সরকারি ছুটির দিন হলে পর্যটকদের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন আমাদের পর্যটন শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের হোটেল-মোটেল-রিসোর্টের রুম, জাহাজ, বোট, গাড়ি ইত্যাদি শেষ মুহূর্তে রিকুইজিশন করে। এ কারণে বাধ্য হয়ে পর্যটকদের পূর্বনির্ধারিত বুকিং বাতিল করতে হয়। এতে হোটেল, মোটেল, জাহাজ, বোট মালিকদের পর্যটকদের জবাবদিহি করতে হয়, জরিমানাসহ ক্ষতিপূরণের সম্মুখীনও হতে হয়।

চিঠিতে বলা হয়, ভরা মৌসুমে ও ছুটির দিনগুলোতেই পর্যটকরা ভ্রমণ করে থাকেন। এ সময় বিভিন্ন হোটেলের রুম, জাহাজ, বোট ইত্যাদি রিকুইজিশন করলে ট্যুর অপারেটররা এবং পর্যটন শিল্পসংশ্লিষ্ট মানুষ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন। পর্যটনশিল্পের প্রতি বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। এতে পর্যটকদের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।

শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও পর্যটকবাহী যানবাহন রিকুইজিশনে নেওয়ার নজির নেই। এ ঘটনা আমাদের পর্যটন খাত সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। তাই পর্যটন খাতকে রিকুইজিশনের আওতামুক্ত রাখতে পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। ’

রিকুইজিশনের কবলে পড়ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের হাউসবোটও। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাওরের আশপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের চলাচলের জন্য ৪০টির মতো বিলাসবহুল হাউসবোট রয়েছে। আকর্ষণীয় এসব হাউসবোট প্রশাসনের রিকুইজিশনের কবলে পড়েছে। বোট মালিকরা জানান, রিকুইজিশনে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হাউসবোটগুলো বেছে নেওয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন এসব বোট রিকুইজিশনে নিলেও ব্যবহার করা হয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টাঙ্গুয়ার হাওর ও নীলাদ্রী লেকে ব্যক্তিগত ভ্রমণে। জুন থেকে এ পর্যন্ত ১৮টি হাউসবোট রিকুইজিশনে নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এর মধ্যে কোনোটি এক দিন, কোনোটি এক রাত ও দুই দিনের জন্য রিকুইজিশন করা হয়েছে। আকস্মিক রিকুইজিশনের কারণে পর্যটন ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে নানামুখী সমস্যায়ও পড়ছেন।

পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরে চলাচলকারী একটি হাউসবোট তৈরিতে ৩০ থেকে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এ বছর বন্যার কারণে দেড় মাস হাউসবোটগুলো ব্যবসা করতে পারেনি।

হাউসবোট ‘ব্ল্যাকপার্লের’ ব্যবস্থাপক রুবেল দাশ বলেন, ‘রিকুইজিশনের কারণে গত ৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় থানার ঘাটে আসি। ৯ সেপ্টেম্বর স্যারদের নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাই, রাতে নীলাদ্রী লেক এলাকায় থেকে পরের দিন তাহিরপুর ফিরে আসি।’

তার ভাষ্য, ওই ট্রিপের জন্য তার নির্ধারিত দুই দিনের বুকিং বাতিল করতে হয়েছে। বুকিংয়ের পর্যটকরদের ২৮টি টিকিটের দামও তাঁদের পরিশোধ করতে হয়েছে। প্রশাসন থেকে শুধু নৌকার তেল খরচ পেয়েছিলেন।

‘জলপদ্ম’ হাইসবোটের ব্যবস্থাপক সঞ্জয় দত্ত জানান, এই মৌসুমে (জুন থেকে এ পর্যন্ত) পর্যটকদের নিয়ে তিনি ২৫টি ট্রিপ দিয়েছেন। তবে লিখিতভাবে তাঁর বোটটি দুইবার রিকুইজিশন হয়েছে। অলিখিতভাবে দুইবার। বিনিময়ে কর্মীদের খাবার ও তেল খরচ পেয়েছেন। তবে প্রতিবার রিকুইজিশনে তাঁদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এতে পর্যটনসেবা প্রশ্নবিদ্ধ হয় পর্যটকদের কাছে।

‘নোঙর’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউসুফ রানা জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরে চলাচলকারী ৪০টি হাউসবোট রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি বোট রিকুইজিশনে নেওয়া হয়। কোনোটি এক দিন, আবার কোনোটি টানা দুই দিন।

তাহিরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম হাক্কানি বলেন, ‘পুলিশ নিজেদের প্রয়োজনে কোনো হাউসবোট রিকুইজিশন করেনি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এনডিসি স্যার (নেজারত ডেপুটি কালেক্টর) ইউএনও অফিসে রিকুইজিশনের কাগজ পাঠান। আমরা শুধু সেই কাগজ হাউসবোটের কাছে পৌঁছে দিই। ’

সদ্য যোগ দেওয়া তাহিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসাদুজ্জামান রনি বলেন, প্রশাসনিক প্রয়োজনেই বিধি অনুযায়ী রিকুইজিশন করা হয়। জেলা প্রশাসক স্যার নিজ ক্ষমতাবলে এই রিকুইজিশন করতে পারেন।

ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, ‘রিকুইজিশনসংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে আমরা সমন্বয় করার চেষ্টা করছি। ট্যুর অপারেটররা যদি তাঁদের হোটেল, মোটেল, জাহাজ, বোট, গাড়ির বুকিংসংক্রান্ত তথ্য জেলা প্রশাসন বা আমাদের জানায়, তাহলে সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে। সরকারি কাজে রিকুইজিশন আমরা বন্ধ করতে পারব না। কিন্তু কিভাবে সমন্বয় করে সমাধান করা যায়, এ ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করব।’

কর্ণফুলী টানেল: পর্যটনে যোগ হবে নতুন মাত্রা
এ দেশে পর্যটন কি ‘গলাকাটা ব্যবসা’ হয়ে উঠছে

আপনার মতামত লিখুন