বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং পরবর্তী বাংলাদেশ
এ এইচ এম খায়রুল আনম সেলিম -ফাইল ছবি
ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭২ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন জাতির জন্য একটি বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুযন্ত্রণা শেষে লন্ডন-দিল্লী হয়ে এই দিনে তিনি স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন। লন্ডন ও দিল্লী উভয় জায়গাতেই তিনি পেয়েছিলেন বীরোচিত সংবর্ধনা। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির সংবাদটি বিশ্বের প্রায় সকল মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছিল। ঐ দিন সকাল ৭টায় বিবিসি’র ওর্য়াল্ড সার্ভিসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তির বার্তা প্রচারিত হলে বাঙালি জনতা দীর্ঘ প্রতিক্ষায় থাকে প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যডওয়ার্ড হিথ সেদিন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর দেশে নজিরবিহীন সম্মাননা দেখিয়েছিলেন। ঐ দিন কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধুর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন হিথ। হাজার হাজার বাঙালি সেদিন লন্ডনের হোটেল ঘিরে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে আলিঙ্গন করেছিল প্রিয় নেতার সাথে।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই নবীন রাষ্ট্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধকালীন ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে চরম দুর্বিসহ জীবন কাটিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তেজগাঁও বিমান বন্দরে সেদিন লাখ লাখ জনতা প্রিয় নেতার মুখ দেখার জন্য দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন স্বাধীন দেশের মাটিতে পা ফেলে আবেগে কেঁদেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে বিভিন্ন বিষয়ের দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যে ভাষণে দেশ গঠনের নির্দেশনা ছিল। এর পর শুরু হল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ।
রেসকোর্সের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে নতুন কবিতা সৃষ্টি করতে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার জন্য। সদ্য স্বাধীন দেশ। চারদিকে ধ্বংসস্তুপ। রাষ্ট্রীয় কোষাগার ছিল পাকিস্তানে। দেশ চালানোর মত অর্থ ছিল না। ছিল না দক্ষ জনপ্রশাসন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন বাংলাদেশে। শুরু করেন দেশ গঠনের নয়া সংগ্রাম। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি সময় পেয়েছিলেন। এই সময়ের মধ্যে পর্বত পরিমাণ বাধা ও সমস্যা মোকাবেলা করে দেশকে উন্নয়নের নতুন সীমানায় নিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী চক্রও থেমে থাকে নি। তারাও রচনা করে একের পর এক ফাঁদ। ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র। এরই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু বিরোধী নানা অপকৌশল রচনা করে। মানুষকে বিভ্রান্ত করে বঙ্গবন্ধুর নামে নানা অপবাদ দিয়ে। তাদের সঙ্গে হাত মেলায় বাংলাদেশের মীরজাফররা। আর সেই সব ষড়যন্ত্রেরই চূড়ান্ত পরিণতি হল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিপন্ন করা, বঙ্গবন্ধুর অবদানকে হেয় প্রতিপন্ন করা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা নস্যাৎ করা, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে ফিরিয়ে আনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশাসনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল একটি বহুত্ববাদী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। কেননা পাকিস্তান প্রশাসনে সমাজ বিভক্ত ছিল নানা শ্রেণি ও সমাজে। তখন শ্রেণি বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। সমাজে সুবিধাবাদী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের এটিও ছিল একটি অন্যতম কারণ। বঙ্গবন্ধুর নয়া নীতি ও নতুন ব্যবস্থা দেশের কায়েমী স্বার্থ ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে আঘাত করেছিল নিঃসন্দেহে। তাই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে। আর এ চক্রান্তে যুক্ত হয় আরো অনেক দেশী বিদেশী সাম্রজ্যবাদী ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন- আমার দেশ স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক কারো এমন শক্তি নেই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কেননা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সমাজবাদী দেশগুলোর সাথে আর্থ-সামাজিক সহযোগিতামূলক নীতি, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক দর্শন ইত্যাদি পশ্চিমা সাম্রজ্যবাদী শক্তির স্বার্থে সরাসরি প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি (সেকুলারিজম) মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রনায়কদের অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। ফলে দেশে বিদেশে বঙ্গবন্ধুর শত্রুর কোনো অভাব ছিল না, যাদের সম্মিলিত চক্রান্ত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দানা বেঁধে একত্রে কার্যকর হয়ে উঠেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আর আমরা হারালাম আমাদের প্রিয় নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর নীতি বাস্তবায়িত হলে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আরো উন্নত হতো। একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা পেত, তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন পৌঁছাত, দুর্নীতি নিয়মে পরিণত হতো না, একটি সুষম ব্যবস্থা তৈরী হতো।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে তাঁর নেতৃত্বে এদেশ একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতো। বহু আগেই আমরা পেতাম দারিদ্র্য, শোষণ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ। সুষম অর্থনীতির কারণে তৈরী হতো একটি সুষম সমাজ ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুরের আজকের উন্নয়নের পিছনে রয়েছেন লি কুয়ান নামের মানুষটি। তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন। তেমনি বঙ্গবন্ধুর অভিভাবকত্ব প্রশ্ন না করে মেনে নিলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশও আজ সিঙ্গাপুরের ন্যায় সমৃদ্ধ ও উন্নত হতে পারত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধুকে এই স্বপ্নটি পূরণ করতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের রূপকল্প এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের। দেশকে ভালোবেসে আমাদের এখন ঐকবদ্ধ হয়ে কাজ করার সময়। এজন্য প্রয়োজন হবে সকলের সমন্বিত প্রয়াস।
এ এইচ এম খায়রুল আনম সেলিম
সভাপতি, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ; চেয়ারম্যান, সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ, নোয়াখালী।
আপনার মতামত লিখুন