খেলার মাঠ নয়, শ্রমের মাঠে শিশুরা; সুবর্ণচরের হাটে বিক্রি হচ্ছে শৈশব

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্কুলব্যাগ নয়, কোমরে কাপড়ের থলে, হাতে কাস্তে। খেলনা নয়, ঘাম ঝরানোর সরঞ্জাম। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের আটকপালিয়া বাজারে শিশুদের দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বোঝা যায়—এটা কোনো সাধারণ হাট নয়, এ যেন দরিদ্রতার নীল নকশায় আঁকা শৈশব বিক্রির মঞ্চ।
প্রতি শুক্র ও সোমবার এই হাটে বিক্রি হয় শ্রম। আর সেই শ্রমের বড় অংশই আসে শিশুদের কাছ থেকে। অভাবের তাড়নায়, সংসারের চাপে কিংবা অভিভাবকের অসুস্থতায়—বয়স যাদের খেলাধুলার, তারা এখন জীবিকার তাগিদে দাঁড়িয়ে থাকে মহাজনের চোখে পড়ার আশায়।
রিফাত, নাজমুল, জিয়া, সাইফুর—নাম ভিন্ন হলেও গল্প প্রায় একই। কেউ অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, কেউ চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র; কিন্তু সবাই এসেছে কাজ খুঁজতে। কেউ বলছে, “মা একা, তাই আসছি,” কেউ বলছে, “বাবা অসুস্থ, খাবার জোগাতে হবে।”
দুপুর পর্যন্ত হাটে দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ কেউ ফিরে যায় খালি হাতে, কারণ দাম মেলেনি চাহিদার সঙ্গে। যাদের নেওয়া হয়, তাদের দিন শুরু হয় ভোর ৬টায়, চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। মজুরি দৈনিক ৩৫০-৪০০ টাকা, বিশ্রাম মাত্র ১ ঘণ্টা।
এই শ্রমের পেছনে নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই সুরক্ষা, নেই শিশুবান্ধব পরিবেশ। শুধুই রুক্ষ বাস্তবতা। সুবর্ণচরের আরও কিছু এলাকায়, যেমন পূর্ব চরবাটা ছমির হাট, চরবাটা খাসের হাট, চরওয়াপদা থানার হাট, চরক্লার্কেও চলছে এমন মানবেতর দৃশ্য।
সুবর্ণচরের স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল বারী বাবলু বলেন, ‘যে বয়সে লেখাপড়া আর খেলাধুলা করে মায়ের আঁচলের নিচে ঘুমানোর কথা। সেই বয়সে ওরা মহাজনের বাড়িতে ঘুমানোর সব প্রস্তুতি নিয়ে শ্রমের হাটে আসে। অন্যদিকে শিশু মজুরদের খাবার বা চিকিৎসার নিশ্চয়তা থাকে না। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শিশুরা মাঠে কাজের উদ্দ্যেশ্যে ছুটে যেতে হয়। মহাজনের ইচ্ছানুযায়ী কাজের তালিকায় থাকে ধান কাটা, রবি ফসলের ক্ষেত তৈরি, চারা রোপণ, পানি তোলা ছাড়াও নানা ধরনের কাজ। যা অনেক শিশুর জন্য অসাধ্য হয়ে ওঠে।’
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক দেলোয়ার হোসেন জানান, “শিক্ষার বদলে শিশুরা যদি শ্রমে জড়ায়, তা জাতির জন্য ভয়াবহ সংকেত।” আইনজীবী আবুল হোসেন রাজু বলেন, “শিশু নিয়োগ শ্রম আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।”
সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাবেয়া আসফার সায়মা জানান, শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসন তৎপর, তবে এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ আরও জোরালো হওয়া জরুরি।
আপনার মতামত লিখুন