শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অর্থনীতি

সম্ভাবনার নতুন দুয়ার : সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড

মোস্তাফিজুর রহমান
০১ জানুয়ারি ২০২২

সমুদ্রের অথৈ জলের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে হাজারও বিস্ময় ও রহস্য। পৃথিবীর আশ্চর্য ও সুন্দর জিনিসগুলোর মধ্যে সমুদ্র অন্যতম। তাই তো ভ্রমণপিপাসু বাঙালিদের সমুদ্র ভ্রমণের ইচ্ছা নিয়ে আগ্রহের কোনো কমতি নেই। বঙ্গোপসাগরের অন্যতম মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। বিশাল বিশাল তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর, কচ্ছপ আর বিরল প্রজাতির জলজপ্রাণীর অভয়ারণ্য সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। আগামী দিনে বাংলাদেশের সমুদ্রভ্রমণের অপার এক সম্ভাবনার নাম এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই দেখা মিলে নীল জলরাশির বিস্তীর্ণ রাজ্য। এর নামই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত এলাকা এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। পৃথিবীর ১১তম গভীর সমুদ্রখাদ। আয়তনে এটি ছয়টি ঢাকা মেট্রোপলিটনের সমান।

চলুন একটু পেছনের দিকে যাই। ১৮৬৩ সাল। বেশ কয়েকদিন ধরে বঙ্গোপসাগরে জাহাজে চড়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন একদল ব্রিটিশ গবেষক। সাথে ছিলেন একদল জরিপকারীও। বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন সহ ভারত থেকে ব্রিটেন যাওয়ার পথে ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ হয়ে যায় ২১২ টন ওজনবিশিষ্ট একটি গানবোট। গ্যাডফ্লাই নামে সেই গানবোটটির খোঁজেই তাদের এই অভিযান।

সুন্দরবন থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে তাদের এই অভিযান। অনেক চেষ্টার পরে অবশেষে গ্যাডফ্লাই ডুবে যাওয়ার সম্ভাব্য স্থানটি আন্দাজ করা যায়। কিন্তু সেটি উদ্ধারের কোনো আশা ওই ব্রিটিশ গবেষকদের কাছে আর অবশিষ্ট ছিল না।

জেলেদের কাছে জায়গাটি পরিচিত নাই বাম নামে। যার অর্থ তলাবিহীন। মানে এর তলের কোনো হিসাব নেই। ব্রিটিশ গবেষকরাও তাদের বিলেতি যন্ত্রপাতি দিয়ে এই নাই বামের তলা খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন তারা মনে করেছিলেন আসলেই এর বুঝি কোনো তলই নেই। তাই তো তারা এর নাম দিয়েছিলেন সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। বাংলায় যাকে বলে অতলস্পর্শী।

বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত এলাকা এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। বিশে^র বৃহত্তম এই ডুবো গিরিখাদ সৃষ্টি হয়েছিল এক লাখ ২৫ হাজার বছর কিংবা তারও আগে। তবে এটি সবার নজরে আসে ২০১৪ সালে।

বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানকে কোনাকুনিভাবে অতিক্রম করেছে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। এটি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। গঙ্গা খাদ নামেও এটি পরিচিত।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের আরো কিছু ব-দ্বীপমুখী খাদ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিন্ধু নদীর মোহনার অদূরে সিন্ধু খাদ, মিসিসিপি ব-দ্বীপের পশ্চিম পাশে মিসিসিপি খাদ অন্যতম।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের প্রস্থ পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার। তলদেশ তুলনামূলকভাবে সমতল এবং পাশর্^ দেয়াল প্রায় ১২ ডিগ্রি হেলানো। মহীসোপানের কিনারায় খাদের গভীরতা প্রায় এক হাজার ২০০ মিটার।

অত্যাধুনিক সোনার প্রযুক্তি দিয়ে জরিপ করা হয় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের। ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের নিচে কান্দা ও উপ-বদ্বীপ উপত্যকার আকারে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সাগর অভিমুখে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার সম্প্রসারিত হয়ে আছে।

সমুদ্রবিজ্ঞানীদের মতে, এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড একটি সামুদ্রিক অভয়ারণ্য। বঙ্গোপসাগরের অন্যতম মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে নানা জাতের সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি আছে বিশাল তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর, কচ্ছপ আর বিরল প্রজাতির কিছু জলজপ্রাণী।

বিস্তীর্ণ এলাকাটি বিরল জীববৈচিত্র্যের নিরাপদ প্রজননকেন্দ্র, যা প্রস্তাবিত ব্লু-ইকোনমির জন্য হয়ে উঠতে পারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ওই এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে এমন তথ্য দিচ্ছেন গবেষকরা।

প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই গভীর খাদটি সমুদ্রের অন্যান্য অংশ থেকে গভীর বলে এটি নানা সামুদ্রিক প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। এসব সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- তিমি, পপাস ডলফিন, পৃথিবীর বৃহত্তম ইরাবতি ডলফিন, গোলাপি পিঠের কুঁঁজো ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন ও মসৃণ পিঠের পাখনাহীন ইমপ্লাইস ডলফিন। এ ছাড়া এটি ডলফিন পরপাস ও তিমির প্রজননক্ষেত্রও। বিজ্ঞানীর জানান, এটিই পৃথিবীর একমাত্র সোয়াচ যেখানে এই তিন প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী একসাথে দেখা যায়।

বছর চারেক আগে ২০১৭ সালে ইসাবেলা ফাউন্ডেশন নামে একটি জরিপ সংস্থার অভিযানে এখানে হ্যামারহেড শার্ক ও চার প্রজাতির ডলফিন শনাক্ত করা হয়। গবেষকদল দেখতে পায়, সাগরতলের গভীর উপত্যকা বা মেরিন ভ্যালির পানির রঙ পরিবর্তিত হয়ে নীল রঙ ধারণ করেছে। সোয়াচের মূল্যবান জীববৈচিত্র্যের তথ্যভাণ্ডারও অবাক করেছে তাদের।

বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলে সীমিত পরিসরে জাহাজ চলাচল করছে। এখান থেকে ব্যাপকভাবে মাছও আহরণ করা হচ্ছে না। ফলে সোয়াচ এখনো বাংলাদেশের সাগরে অনাবিষ্কৃৃত ইকোসিস্টেম হিসেবে কাজ করছে। সেখানে এমন কিছু প্রাণী রয়েছে, যেগুলো বিশ্বে বিলুপ্তির তালিকায় রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ইকোলজিক্যালি, জিওলজিক্যালি, হাইড্রোলজিক্যালি এবং আন্তর্জাতিক বায়োডাইভারসিটি হটস্পটও।

বিভিন্ন গবেষকদের তথ্য থেকে জানা গেছে, ১৯১৪ সালের ২৭ অক্টোবর এই এলাকাটিকে বাংলাদেশের প্রথম মেরিন প্রটেক্টেড অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রাথমিকভাবে ডলফিন, তিমি, হাঙ্গর দেখে এই জরিপ করা হয়েছিল।

কিন্তু পানির নিচে যে জীববৈচিত্র্য আছে বিশেষ করে ঝিনুক, শামুক, সাপ, সি-উইডস এসবের তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর সোয়াচের পানি খুবই পরিষ্কার। এই পানির গুণগতমান শ্রীলঙ্কা, ভারত, মিয়ানমার ও মালদ্বীপের চেয়েও উন্নত। আর তাই এটি এ অঞ্চলের জন্য ইকোলজিক্যাল ফিল্টার হিসেবে কাজ করছে।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড হতে পারে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আকর্ষণীয় এক স্থান হলো সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। গভীর সমুদ্র কিংবা সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য কিংবা সমুদ্রের বিশালতা দেখা যাদের আগ্রহ তাদের জন্য এটি একটি পারফেক্ট জায়গা।

এখানে পানির কাছাকাছি সি-গালের অবস্থান দেখে বোঝা যায় ডলফিন এবং তিমির অবস্থান। দৈত্যাকার তিমির উপস্থিতি মুহূর্তে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও সৃষ্টির এমন রহস্য কাছ থেকে দেখে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবানই মনে হবে। এ ছাড়া সামুদ্রিক রহস্যময় জীবজগতের মধ্যে এখানে দেখা যায় অন্তত ১০ প্রজাতির পাখি এবং ৩০ প্রজাতির মাছসহ আরো নানা জাতের প্রাণী। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে হওয়ায় এখানে যেমন নৌযানে ভেসে বেড়ানো যাবে তেমনি রয়েছে স্কুবা ড্রাইভিংয়েরও সুযোগ।

তবে এই জায়গাটিতে যাওয়া কিন্তু একেবারে সহজ নয়। সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে আবহাওয়া কেমন সে বিষয়ে। সমুদ্র শান্ত থাকলেই কেবল শুরু করতে হবে যাত্রা। যাওয়ার বাহনও হতে হবে গভীর সমুদ্রে ভ্রমণ উপযোগী। এখানে যাওয়ার জন্য বাগেরহাট বা খুলনা থেকে রওনা দেয়া সুবিধাজনক। মংলা বন্দর থেকে ট্রলার কিংবা লঞ্চ ভাড়া করে যেতে হবে। বড় গ্রুপ হলে বিআইডব্লিউটিসির সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত বিশে^র গভীরতম ডুবো গিরিখাদগুলোর একটি। বঙ্গীয় উপ-বদ্বীপের অংশ এই অঞ্চলটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের শ্রেষ্ঠ হটস্পটগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ এক অমিত সম্ভাবনার উৎস হলেও সমুদ্র গবেষণায় সীমাবদ্ধতা ও অনগ্রসরতার কারণে এখনো সোয়াচটির সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

এটি নিয়ে গবেষণাও রয়েছে শুরুর পর্যায়ে। ব্যাপক গবেষণা চালালে হয়তো বিস্ময়কর অনেক কিছুই পাওয়া যাবে এখানে। দেশের পর্যটন খাত, ব্লু-ইকোনমি কিংবা মৎস্য খাতের জন্য এটি খুলে দিতে পারে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভবিষ্যতের জন্য খনিজ তেল বা গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক একটি বিশাল অনাবিষ্কৃত উৎস হয়ে থাকতে পারে এ মেরিন ভ্যালি। সামগ্রিকভাবে দেশের ব্লু-ইকোনমির জন্য খুলে দিতে পারে সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার।

বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ডের লক্ষ্য পূরণের প্রত্যয়ে ওয়ালটনের

আপনার মতামত লিখুন