শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ইভেন্ট

বান্দরবানের পর্যটনে হতাশা, রাঙ্গামাটিতে আশার আলো

নিজস্ব প্রতিবেদক
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

দেশের এক-দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পর্যটনে সম্ভাবনাময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার পর্যটন শিল্প করোনা মহামারীর কারণে আবারো ক্ষতির মুখে পড়েছে। পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত এখানকার হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ায় কষ্টে দিন গুজরান করছেন। অন্য দিকে অপর পর্যটন জেলা রাঙ্গামাটিতে পর্যটন খাত করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে শুরু করায় সেখানে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। 

করোনায় বিপর্যস্ত বান্দরবানের পর্যটন খাত:
করোনায় আবারো ক্ষতির মুখে পড়েছে বান্দরবানের পর্যটন শিল্প। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সম্ভাবনাময় বিশাল এ খাতটি। গত দুই দশকে গড়ে ওঠা পাহাড়ের পর্যটন এখন কঠিন সময় পার করছে। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী এবং এ খাতের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। প্রতি বছর শীতের মৌসুমে নীলগিরি, নীলাচল, মেঘলা, বগালেক, বড় পাথর, রিজুক ঝরনাসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত থাকে। করোনার কারণে এবার শীতের মৌসুম পর্যটকশূন্য। পর্যটক না আসায় দিন দিন বাড়ছে এ খাতে আর্থিক ক্ষতি। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগের পরও আয়শূন্য হোটেল রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা।

গেল বছর পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকার পর খুলে দেয়া হলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে পর্যটকদের আনাগোনা কমে যায় বান্দরবানে। করোনার আতঙ্কে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্রগুলো। বান্দরবান হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন করোনায় পর্যটকদের আনাগোনা প্রায় বন্ধ। এতে হোটেল-মোটেল মালিকদের ক্ষতি শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই প্রায় নিঃস্ব। এই অবস্থা চলমান থাকলে বিপাকে পড়বে পর্যটন খাতসহ সংশ্লিষ্টরা। এ দিকে পর্যটক না আসায় হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বেকার হয়ে পড়েছে শত শত শ্রমিক। পর্যটক কমে যাওয়ায় পর্যটনের সাথে সংশ্লিষ্ট পর্যটকবাহী গাড়িগুলোর শ্রমিক-মালিকরাও পড়েছেন বিপাকে। ফলে এ পেশার মানুষগুলোর দিন কাটছে কষ্টে। পর্যটন উদ্যোক্তা মোহাম্মদ জাকির জানান ‘করোনাকালে হোটেল-মোটেল ব্যবসায় আয় না থাকলেও কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। পর্যটক না থাকলেও রিসোর্টগুলোতে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমেনি। ফলে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন।

রিসোর্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইয়াসিনুল হাকিম জানান, গত বছর করোনার প্রাদুর্ভাবে পাঁচ মাস বন্ধ ছিল পর্যটন কেন্দ্রগুলো। এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই আবারো করোনার থাবায় পর্যটকদের আগমন অনেক কমে গেছে। করোনায় বিপর্যস্ত পর্যটন খাতের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা নিয়েও শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। হোটেল মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ও অমল কান্তি দাশ জানান হোটেল-মোটেলের সংখ্যা এখন অনেক। এসব হোটেল-মোটেল বন্ধ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে অনেক ব্যয় হচ্ছে। সরকারি প্রণোদনা না পেলে মুখ থুবড়ে পড়বে পর্যটন খাত।

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রাঙ্গামাটির পর্যটন
এ দিকে করোনা কাটিয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রাঙ্গামাটির পর্যটন খাত। রাঙ্গামাটি কাপ্তাই বিলাইছড়ি ও সাজেকের দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের আগমন বাড়তে শুরু করেছে। করোনাকাল কাটিয়ে উঠার পর পর্যটকের আগমন বাড়তে শুরু করায় ব্যস্ততা বাড়ছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। আপাতত করোনার কারণে খুব বেশি পর্যটক না এলেও অল্প অল্প করে পর্যটক আসছেন। এ মাসের মাঝামাঝি থেকে পর্যটক আগমন পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারে।

দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পাহাড়ি পর্যটন এলাকা রাঙ্গামাটি। মূলত শীত মৌসুমে এ জেলায় পর্যটকের আনাগোনা বাড়ে। করোনা কাল অতিক্রম করে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত মৌসুমে পর্যটকের ঢল নামে। কিন্তু জানুয়রির মাঝামাঝি করোনা সংক্রমণ বাড়লে রাঙ্গামাটিতে পর্যটকের আগমন কমে যায়। কিন্তু প্রশাসন থেকে পর্যটকের আগমনে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বর্তমানে ফেব্রুয়ারির মাঝামঝি সংক্রমণ কমে আসতে থাকায় আবারো পর্যটকের আগমন বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউজে পর্যটকদের আগাম বুকিং বেড়েছে। পর্যটকদের জমজমাট উপস্থিতিতে রাঙ্গামাটির পর্যটন ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা জমে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।

রাঙ্গামাটিতে পর্যটকদের বিনোদনের জন্য রয়েছে ঝুলন্ত ব্রিজ, আরণ্যক রিসোর্স হ্যাপী আইল্যান্ড, ডিসি বাংলো, পলওয়েল ইকো পার্ক, বার্গী রিসোর্ট, মিনি চিড়িয়াখানা, রাজবন বিহারসহ বিশাল কাপ্তাই হ্রদ।

এবার ১৪ ফেব্রয়ারি ভালোবাসা দিবস আর ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ছুটি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটি থাকায় অবকাশ কাটাতে নানান পর্যটন কেন্দ্রে মানুষের আগমন বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে রাঙ্গামাটির পর্যটন ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া বলেন, অভ্যন্তরীণ পর্যটক এরই মধ্যে অনেক বেড়েছে। দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্যান্য সময়ের তুলনায় পর্যটক এখন অনেক বেশি। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা রেখেছি। আশা করছি সামনে প্রচুর পর্যটকের সমাগম হবে। করোনা সংক্রমণ হ্রাস পাওয়ায় আবারো রাঙ্গামাটিমুখী হয়ে আছেন অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা। অনেকেই পাহাড় কিংবা সমতলের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরতে রাঙ্গামাটি বেড়াতে আসতে শুরু করেছেন। এককথায় প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসবেন পাহাড়ে। পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে রাঙ্গামাটি।

তিনি জানান, করোনাকালে পর্যটন ব্যবসা সচল রাখতে একটি নীতিমালাও করা হয়েছে। পর্যটকরা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতনভাবে বেড়াতে যান, সেজন্য প্রশাসন থেকে ব্যাপক প্রচারণাও আছে।

পর্যটন খাতের উন্নয়নে কাজ করছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান সিএইচটি টুরিজম অ্যান্ড কালচার রিসার্চ সেন্টার পরিচালক উচিং ছা রাখাইন বলেন, অভ্যন্তরীণ পর্যটনশিল্প চাঙ্গা হতে শুরু করায় উদ্যোক্তাদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। এতে পাহাড়ের পর্যটন খাত লাভবান হচ্ছে। অনেকেই অংশীদারিত্বে ইকো ট্যুরিজম ব্যবসায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এককথায় পর্যটন খাতে কর্ম তৎপরতা বাড়ছে। তার মতে, জনজীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে এখন মানুষ ঘুরে বেড়াতে পারবেন।

রাঙ্গামাটি, সাজেক কাপ্তাইয়ের বিনোদন স্পটগুলো পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া আছে। পর্যটকদের আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের পুরো পর্যটনশিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যান্ত্রিক জীবনের একটু ক্লান্তি দূর করতে বিনোদনের খোঁজে নগরের মানুষ ছুটিতে ছুটে আসবেন পাহাড় হ্রদ ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক লীলাভূমি রাঙ্গামাটিতে। আর বেড়াতে আসা পর্যটকরা ঝুলন্ত সেতুসহ নানা নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখার সাধ মিটিয়ে নিতে পারবেন। পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত হোটেল-মোটেল রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন ইতোমধ্যে হোটেল-মোটেলগুলোতে সিট বুকিং বেড়ে গেছে।

বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকরা আকর্ষণীয় ঝুলন্ত সেতু, পলওয়েল পার্ক, ডিসি বাংলো, আরণ্যক রিসোর্ট, হ্যাপী আইল্যান্ড, বার্গী রিসোর্টসহ নানান স্থানে ভিড় করে থাকেন। এ ছাড়া কাপ্তাই হ্রদ, কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি শহরের বরগাঙ ও বেরাইন্যাতে ঘুরে বেড়ান পরিবার-পরিজন নিয়ে। এবারো পর্যটকদের আগমনের অপেক্ষায় আছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

রাঙ্গামাটি টেক্সটাইল মার্কেটের বিক্রেতারা জানান, শীতকাল হওয়ায় পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ স্থানীয় তাঁতে তৈরি গামছা ও চাদরের প্রতি। এ ছাড়া যারা পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসেন, তারা অনেকেই পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিনতে পছন্দ করেন। সব মিলিয়ে পাহাড়িদের স্থানীয় তাঁত বস্ত্রের ব্যবসা জমে উঠবে বলে তারা আশা করছেন।

এ দিকে কাপ্তাই হ্রদে বোটে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকদের অত্যন্ত আনন্দের। ইঞ্জিনচালিত ট্যুরিস্ট বোটচালক মো: আলাউদ্দিন বলেন, সারা বছরের তুলনায় এ মৌসুমে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ে। করোনা কমে আসায় আবারো পর্যটক আসতে শুরু করেছে। তবে সব পর্যটক হ্রদে তেমন একটা ঘুরে বেড়ান না। তবুও টুরিস্ট বোট ভালোই ভাড়া হচ্ছে।

রাঙ্গামাটি পর্যটন বোট ঘাটের ম্যানেজার রমজান আলী জানান, সারা বছর পর্যটকদের সমাগম কম থাকায় ট্যুরিস্ট বোটও কম ভাড়া হয়। আমরা মূলত পর্যটন মৌসুমের দিকেই চেয়ে থাকি। এ সময়ে পর্যাপ্ত বোট ভাড়া হওয়ায় এ খাতে জড়িতদের আর্থিক সচ্ছলতা ফেরে।

পর্যটকশূন্য খাগড়াছড়ি

এ দিকে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির পর থেকে খাগড়াছড়ির পর্যটনকেন্দ্রগুলো প্রায় পর্যটকশূন্য। হোটেল-রেস্তোরাঁ, পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন। শীতের শুরুতে স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক আসতে শুরু করলেও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে এখন সুনসান নীরবতা। পর্যটক না থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে বিভিন্ন হোটেল-মোটেল মালিকসহ পরিবহন সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পার্কের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা থাইয়োংগ্য মার্মা জানান, করোনার প্রকোপ কমে অক্টোবরের শেষে ও নভেম্বরের শুরুর দিকে পর্যটকের আগমন হলেও ডিসেম্বরের শেষ দিকে তা একেবারেই শূন্যের কোঠায়। জেলা পরিষদ পার্কে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই শত পর্যটক এবং ছুটির দিনে প্রায় পাঁচ শত পর্যটক আসত এবং ভালো আয় হতো। কিন্তু বর্তমানে গড়ে তা এক শ’রও নিচে।

খাগড়াছড়ি শহরের বিলাসবহুল হোটেল অরণ্য বিলাসের ম্যানেজার রাজীব দেব বলেন, শীতকাল আমাদের জন্য মৌসুম। শীতকালে পর্যটকদের কাছ থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে আমরা সারা বছর কর্মচারীদের বেতনসহ যাবতীয় ব্যয় বহন করে থাকি। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবৎ করোনার কারণে পর্যটক না আসায় আমরা বিপুল লোকসানে রয়েছি। এ বছর আশাবাদী ছিলাম ভালো কিছু হবে, কিন্তু জানুয়ারির এক তারিখ থেকে কোনো পর্যটকই আসছে না।

হোটেল গ্রিন স্টারের মালিক কল্যাণ মিত্র বড়ুয়াও অনেকটা একই সুরে জানান, খাগড়াছড়ি ও সাজেকে দুই শতাধিক হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউজ আছে। গড়ে দশ হাজার লোক এই পর্যটন ব্যবসায় সরাসরি জড়িত। যে ক্ষতি হচ্ছে তা পূরণ হবে না। পর্যটন খাতের বিষয়ে সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

সেন্টমার্টিন-হুন্ডাই পরিবহনের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি এরশাদ হোসাইন দুঃখ করে বলেন, আমাদের পরিবহন খাত ধ্বংসের মুখে বিগত বছরগুলোর করোনার প্রভাবে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। এভাবে চলতে থাকলে আমরা পথে বসব।

লাল রঙে সেজেছে যাদুকাটা নদী তীরের শিমুল বাগান
পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে সৌদি আরব

আপনার মতামত লিখুন