শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

নদী বাঁচলে টিকে থাকবে পর্যটন শিল্প

মো. জিয়াউল হক হাওলাদার
২৫ জুন ২০১৯

নদী নিয়ে যত কথা
নদী মানেই মা, নদী মানেই প্রিয়া। তাই তো সব নদীর পাড়ে মানুষের বসতি। নদীর সঙ্গে নদীর, নদীর সঙ্গে সাগরের। সাগরের সঙ্গে মহাসাগরের মিলন হয়। নদীর সঙ্গে মানুষের মিলন নিরবধি। সভ্যতার শুরু থেকে এ মিলন অদ্যাবধি শাশ্বত। নদীর স্নিগ্ধতায় পর্যটকদের প্রাণ ছুঁয়ে যায়, নদীর মিতালি পর্যটকদের মায়াবী সুরে বারবার ডাকে। তাই নদীকেন্দ্রিক পর্যটন আদিকাল থেকে চলে আসছে। বাংলাদেশের নদী

দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্গত বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই শত শত নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে তৈরি হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে অসংখ্য নদ-নদীর মধ্যে অনেকগুলো আকার ও গুরুত্বে বিশাল। এসব নদীকে বড় নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বৃহৎ হিসেবে কয়েকটিকে উল্লেখ করা যায়, এমন কয়েকটি নদ-নদী হচ্ছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্র, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা, গোমতী ইত্যাদি।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের নদীগুলোকে সংখ্যাবদ্ধ করেছে এবং প্রতিটি নদ-নদীর একটি পরিচিতি নম্বর দিয়েছে। এর ফলে তাদের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫টি। পাউবো কর্তৃক নির্ধারিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ১০২টি, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ১১৫টি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী ৮৭টি, উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী ৬১টি, পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী ১৬টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী ২৪টি হিসাবে বিভাজন করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

শীতলক্ষ্যা নদী
শীতলক্ষ্যা নদী বা লক্ষ্যা নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নরসিংদী, গাজীপুর, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২২৮ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা ‘পাউবো’ কর্তৃক শীতলক্ষ্যা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং ৫৫।

উৎপত্তি
এই নদীটি পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের একটি উপনদী (Tributary)। গাজীপুর জেলার টোক নামক স্থানে পুরনো ব্রহ্মপুত্র দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে একটি ধারা বানার নামে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে লাকপুর নামক স্থানে শীতলক্ষ্যা নাম ধারণ করে বৃহত্তর ঢাকা জেলার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীতে পড়েছে। নদীটি প্রায় ১১ কিলোমিটার লম্বা এবং নারায়ণগঞ্জের নিকটে এর সর্বোচ্চ প্রস্থ প্রায় ৩০০ মিটার। এর সর্বোচ্চ প্রবাহ ডেমরার কাছে ২,৬০০ কিউসেক। সারা বছর ধরে এর নাব্য বজায় থাকে। শীতলক্ষ্যার ভাঙন প্রবণতা কম।

বাংলাদেশের এককালীন বিখ্যাত মসলিন শিল্প শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। বর্তমানেও নদীর উভয় তীরে প্রচুর পরিমাণে ভারি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। অধুনালুপ্ত পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল ‘আদমজী জুট মিল’ শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত ছিল। এই নদীর তীরে ঘোড়াশালের উত্তরে পলাশে তিনটি এবং সিদ্ধিরগঞ্জে একটি তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র অবস্থিত। বাংলাদেশের অন্যতম নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জ বন্দর ও শহর এই নদীর তীরে অবস্থিত। শীতলক্ষ্যা তার পানির স্বচ্ছতা এবং শীতলতার জন্য একদা বিখ্যাত ছিল। বছরের পাঁচ মাস নদীটি জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্রভাবিত থাকে, কিন্তু কখনই কূল ছাপিয়ে যায় না।

ইংল্যান্ডের টেমস নদীর পর পৃথিবীর দ্বিতীয় ‘হারবার’ বেষ্টিত শান্ত নদী শীতলক্ষ্যা। এক সময় ইংল্যান্ডের ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরির কাজে এই নদীর স্বচ্ছ সুশীতল পানি ব্যবহার করত। এ নদীর দু’পাড়ে কোনো ভাঙন নেই। ভরা বন্যাতে তেমন ঢেউ উঠে না। মুরব্বিদের মতে, এই নদী নাকি সব নদীর মা। এই কারণে এ নদীর এমন শীতল ও লক্ষ্মী আচরণ। আর এই শীতল এবং লক্ষ্মী আচরণ থেকে এর নাম হয় শীতলক্ষ্যা।

নদী পর্যটন
নদী যেমন মানবজীবনের জন্য সর্বক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনিভাবে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটন শিল্প সমগ্র বিশ্বের নদী এবং পানির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বর্তমানে পর্যটনের নতুন নতুন ডাইমেনশন তৈরি হচ্ছে যেমন ইকোট্যুরিজম, নদীভিত্তিক পর্যটন, দুঃসাহসিক পর্যটন ইত্যাদি। এ ধরনের পর্যটন উন্নয়নের জন্য পানিই হচ্ছে মূল কেন্দ্রবিন্দু। কিছু কিছু দেশ পানিনির্ভর পর্যটন কর্মকাণ্ড যেমন নদীতে প্রমোদভ্রমণ বা নৌবিহার, সমুদ্রে প্রমোদভ্রমণ বা সি ক্রুজিং, স্কুবাডাইভিং, স্নোরকেলিং, সার্ফিং, র‌্যাফটিং, বোট রোয়িং, সমুদ্রে মৎস্য ধরা এবং তা অবলোকন, আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড এক্টিভিটিজ, প্যারাগ্লাইডিং, প্যারাসেইলিং, বার্ড ওয়াচিং ইত্যাদি শুরু করেছে। পর্যটনের প্রধান আকর্ষণগুলো নদীনির্ভর যেমন হাওর, বাঁওড়, সমুদ্র, নদী, সমুদ্র তীর, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদি।

প্রশান্ত অথবা আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে সি ক্রুজিং, মেডিটেরিয়ান সাগর অথবা অন্যান্য সাগর এবং বিভিন্ন প্রধান প্রধান নদী যেমন আমাজান, নীল নদ, রাইন নদী, চাওপ্রিয়া নদীতে নৌবিহার সত্যই মনোমুগ্ধকর। অনেক উন্নত দেশ রয়েছে, যেগুলোর রাজধানী গড়ে উঠেছে সমুদ্র তীর, নদী বা জলাভূমির নিকট। কাশ্মীরের ডাল লেক, কেরালার নদী এবং খাল, ইন্দোনেশিয়ার বালি, জাপানের ওকিনাওয়া, মালদ্বীপ, ফিজি, হাওয়াই, গাম্বিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, মরিশাস, ওয়াশিংটনের মোজেস খাল ইত্যাদি হল বিশ্বের নামকরা পর্যটন গন্তব্য। বাংলাদেশ শত শত সর্পিলাকার নদী এবং খালের জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত। এটি আরও বিখ্যাত নৌবিহারের জন্য। বাংলাদেশে রয়েছে বিখ্যাত নদী যেমন- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কুশিয়ারা ইত্যাদি। ৪৯তম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (CPA) সম্মেলন ২০০৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্য, মাননীয় মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এসব সম্মানিত অতিথিদের জন্য বাংলাদেশ আয়োজন করেছিল ঢাকা টু চাঁদপর নৌবিহারের। তারা এই নৌবিহার খুব উপভোগ করেছিলেন এবং তাদের দারুণ অনুভূতি হয়েছিল।

পানি, হাওর এবং জলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। যেহেতু নদীর দু’ধারে হাজার হাজার গ্রাম এবং স্থানীয় বাজার গড়ে উঠেছে; তাই এখানে নৌবিহার খুবই জনপ্রিয়। পর্যটকরা নদীপাড়ের দিগন্তবিস্তৃত শস্যাদি অবলোকন করতে পারে। তারা মাঠে কর্মরত স্থানীয় লোকদের অবলোকন করতে পারে। তাছাড়া ইলিশ মাছ ধরার দৃশ্য পর্যটকদের কাছে একটি প্রধান আকর্ষণ।

উপসংহার
নদীগুলোর নাব্য ঠিক রাখতে হবে। নদীপথে যাতায়াত জনপ্রিয় করতে হবে। নদীর দূষণ কমাতে হবে। সরকারি উদ্যোগে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নদীকেন্দ্রিক বিনোদন বাড়াতে হবে। নদীকে মা হিসেবে দেখি অথবা প্রিয়া হিসেবে যদি দেখি; তাহলে একে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, সভ্যতা বাঁচবে; পর্যটন শিল্প টিকে থাকবে।

লেখক: ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন

যে পর্যটন কেন্দ্রে নিষিদ্ধ হচ্ছে প্লাস্টিক!
শ্রীমঙ্গলের ‘শান্তিবাড়ি’

আপনার মতামত লিখুন