শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

যাদুকাটা নদীর কান্না, নব্য পুঁজিপতিদের উল্লাস

পিযুষ পুরকায়স্থ টিটু
১৪ জুন ২০২০

রুপের নদী জাদুকাটা প্রাকৃতিক ভাবেই সম্পদশালী। এর উত্তরে মেঘালয় পাহাড়, দক্ষিণে শিমুলবাগান, পূর্বে অদ্বৈত মহাপ্রভূর মন্দির ও হযরত শাহ্পরান রঃ আস্তানা। পশ্চিমে বারিকের টিলা, টেকেরঘাট চুনা পাথর খনি প্রকল্প, বড়ছড়া কয়লা আমদানী কেন্দ্র, নিলাদ্রী লেক ও টাংগুয়ার হাওর। যাদুকাটা নদী প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি, স্বচক্ষে এসে না দেখলে এর বৈচিত্র ও মায়া বুঝা দায়। কত যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই যাদুকাটায় তা এক কথায় বলে শেষ হবে না। মূল নদী থেকে দুটি শাখায় ভাগ হয়ে গোটা তাহিরপুর উপজেলাকে মনে হয় দুই হাত দিয়ে আগলে রেখেছে পরম মমতায়।

আমার যখন তিন বছর বয়স তখন বারুণী মেলায় গিয়েছিলাম বাবা-মায়ের সাথে স্নান করতে। হাজার হাজার মানুষের ভিড় ও ঠেলাঠেলিতে মায়ের হাত কখন যে ছেড়ে দিয়েছিলাম টেরও পাইনি। যখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম তখন দেখি সবাই অপরিচিত। শুরু হল কান্না, আর এই দিকে সবার খোঁজাখুঁজিতে বহুদূরে আমাকে পাওয়া গিয়েছিল।

প্রতিবছর চৈত্রমাসে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে যাদুকাটা নদীর পাড়ে যখন বারুণীমেলা ও গঙ্গা স্নান শুরু হয় তখন শাহ্ আরপিনের আস্তানায় একই সময় ওরস শুরু হয়। নিজ চোঁখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না কি পর্যন্ত লোক হয় এখানে। সারা বাংলাদেশ ও ভারত থেকেও কিছু লোক উৎসবের সময় জড় হন। কয়েক দিন ধরে চলে উৎসব, এখানে এই সময়টাতে উৎসব শুরু হলে সব ধর্মের মানুষের এক মিলন মেলা শুরু হয়। এখানে কোন ভেদাভেদ থাকে না। এই উৎসবটা আমাদের এখানে সব চেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচিত। এই উৎসবটা তাহিরপুর উপজেলার শেষ প্রান্তে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় হয়ে থাকে। সারাদেশের পর্যটকদের কাছেও এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান।

ছোট কাল থেকে আমরা দেখে এসেছি যাদুকাটা নদীতে চৈত্র মাসে বারুণী স্নানের সময় এই নদী দিয়ে স্বচ্ছ জল প্রখর রোদে পাহাড়ি ঠাণ্ডা পানি টলমল করে গড়িয়ে পড়তো। খুব শ্রোত থাকতো পানিতে, এক জায়গায় হাঠু পানিতে দাঁড়িয়ে থাকলে হঠাৎ আবার কোমর পানি হয়ে যেত। নিচের দিকে তাকালে নিজের পা পর্যন্ত দেখা যেত, এত সচ্ছ ছিল এখানকার পানি।

প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে উচু মেঘালয় পাহাড় হতে প্রচুর পরিমানে বালি, পাথর, জ্বালানির কাঠ পানির শ্রোতের সাথে ভেসে আসে। যুগ যুগ ধরে এখানকার স্থানীয় লোকেদের মাধ্যমে নদীর মাঝ থেকে তোলা বালি ও পাথর বিক্রি করা হতো।

কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরে এতে কুনজর পড়ল এলাকার প্রভাবশালী বালু ও পাথর খেকোদের। বর্ষাকালে তারা সঙ্গবদ্ধভাবে এলাকার সাধারণ শ্রমিকদের কিছু বাড়তি সুবিধা দিয়ে সহজে ও খুব কম সময়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভে নদীর তলদেশ থেকে বালি পাথর না তুলে, নদীর পাড়ে গিয়ে বড় বড় স্টিলের নৌকায় ভরে বালি নিয়ে যাচ্ছে। আরেক শ্রেণীর মানুষ রাতে ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালি ও পাথর নিয়ে যাচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। এতে নষ্ট হচ্ছে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র, নদী হারাচ্ছে তার প্রকৃত রূপ। নদীর তলদেশ খনন না হয়ে, নদীর পাড় বড় হয়ে যাচ্ছে। হুমকির মুখে আছে আশে পাশের কয়েকটি গ্রাম। যে কোনো সময় পাহাড়ি ঢলে ক্ষতি হতে পারে এলাকার জনসাধারণের। এলাকার সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করলে এদের নামে দেওয়া হয় বিভিন্ন মিথ্যা মামলা, আর নদীর পাড়ে যাদের জমি আছে, তাদের কাছে বিক্রি না করলে রাতে এদের জমি কেটে বালি ও পাথর তুলে নিয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে কিছু মানুষ এদের কাছে জমি বিক্রি করে দেয়। আবার কিছু মানুষকে বুঝানো হয়ে ৩০ শতক জমির মূল্য হয়তো ২ লাখ টাকা, কিন্তু বালি পাথর তুলে পাওয়া যাবে ২০ লাখ টাকা। এতে লোভে পড়েও এলাকার মানুষ তার নিজের জমি থেকে বালি তুলতে দিচ্ছে। আবার কিছু মানুষ বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে ২০০৯ সালে সিলেট শহীদ মিনারের সামনে সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে বিশাল মানববন্ধন করেছিলাম। তার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা) এটা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা করে। মামলার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে নদীর পাড় কাটার নিষেধাজ্ঞা জারি হলে কিছু দিন বন্ধ থাকে, তারপর আবার শুরু হয়। গত বছর আমরা বর্তমান সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হেসেন রতনকে প্রধান অতিথি করে যাদুকাটার পাড়ে একটি সমাবেশ করেছিলাম। এরপর কিছু দিন বন্ধ থেকে আবার শুরু হয় নদীর পাড় কাটা। কিছু দিন আগে দেখলাম শিমুল বাগানের উত্তর-পূর্ব দিকে বড়টেক জায়গা থেকে রাতে বালি-পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে যে কোনো সময় শিমুল বাগানটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। শিমুল বাগানের খুব কাছ থেকে বালি পাথর তুলে নিয়ে যাচ্ছে কিছু অসাধু ব্যাবসায়ী। শিমুল বাগান রক্ষার জন্য সরকারী ভাবে উদ্যোগ নেয়া হোক। না হয় নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে বাগানটি।

এখন আমরা চাই যে কোনো মূল্যে নদীর পাড় কাটা ও ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালি পাথর উত্তোলন বন্ধ হোক, নদীর মাঝ থেকে সনাতন পদ্ধতিতে সারা বছর বালি পাথর উত্তোলন হোক। নদী ফিরে পাক তার আপন সৌন্দর্য। বজায় থাকুক এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা

পর্যটনে আঁধার পেরিয়ে আলো আসবে
পৃথীবিটা মানুষের একার নয়

আপনার মতামত লিখুন