শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

পৃথীবিটা মানুষের একার নয়

হাসান মাহমুদ গুরু
১৪ জুন ২০২০

একটা ছবির মতো টানানো গ্রাম। গাঁয়ের বুক চিরে বয়ে চলা নদী। নদীর দু'ধারে ঘন সবুজ ঘাসের রাজত্বে সারি সারি বৃক্ষ। দুধসাদা রঙের স্নিগ্ধ কাশফুলের সাথে এখানে উদোম আকাশের মিতালি। নদীর স্বচ্ছ জল, কলকল ধ্বনি মুখরিত করে ছুটে চলে অবিরল।

এখানে কাশবনে পাখিদের সভা বসে। পাখিদের সে সভা বিন্যস্ত হয় কিচির মিচির সুরের সম্মোহনে। বাতাসের গায়ে গায়ে লেগে থাকা মদিরার ঘ্রান, আর দূরে ধানক্ষেতের ধারে ঝাউ হরিতকির বনে পিছলে পড়া অলস দুপুর। এমন অবারিত অনিন্দ্য সুন্দর এ দেশের প্রকৃতি। বৃক্ষছায়ে শুয়ে কতো প্রেম ও প্রণয়ের সুতো গাঁথা হয় এখানে।পাখিদের মুখরতায় বাতায়নে ধরা দেয় বেঁচে থাকার সাধ। যে প্রকৃতি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার সবটুকু রসদ যোগায়, একমাত্র সে মানুষই নিজ হাতে লোভের আগুনে পুড়ে খুন করে তার সবটুকু প্রাণ। এই যেমন ঢাকা। এতো যে তিলোত্তমা রাজধানী, তাতে শুধু মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি আছে। নিদারুন কর্মব্যস্তায় দৈনিক ভাসাভাসি আছে। ইমারতে ইমারতে পাশাপাশি নেই নিশ্বাসের জায়গা। পিচঢালা পথে পথে আবর্জনার স্তুপ, তীব্র শব্দ দূষণে ভারী মগজ, বাতাসে রাজ্যের বিষ। কার্বন সীসা আর ধূলোর নগরে যেন এক নিরব আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে সবাই। এ শুধু কি জীবিকার তাগিদেই নাকি অবহেলা কিংবা লোভেও? ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশায় বর্ষায় হাটু জল। নদী দখলের মহোৎসবে তুরাগ, বুড়িগঙ্গার ব্যবচ্ছেদ। আর ঢাকার চারপাশে খালগুলোর শবযাত্রা পরিবেশকে ঠেলে দিয়েছে এক অনিশ্চিত আগামীর জঠরে। কিন্তু অদৃশ্য এক অনুজীব করোনার হাত থেকে বাঁচতে জনারন্যের রাজধানীতে নেমেছে জন মানবহীন এক স্থবিরতা। এ সুযোগে প্রাণবৈচিত্র্য, প্রাণ-প্রকৃতি হয়েছে অনেকটাই প্রাণোচ্ছল। ঢাকার বুকে মানুষের যথেচ্ছাচার কমে নির্জনতায় প্রাণ পেয়েছে প্রকৃতি। রমনা পার্কে কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শাঁখে শাঁখে সবুজ পাতার আচ্ছাদনে ফিরেছিলো পাখিরা। মানুষের ভীষণ রকম নীরবতায় নাগরিক আকাশে দেখা গেছে ঘুঘু, টিয়া কিংবা চিলেদের দেখা। ১১০-১২০ ডেসিবলের শব্দ দূষণ নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোটায়। যে প্রকৃতিতে মানুষ, বৃক্ষরাজি আর অন্য প্রাণীদের থাকার কথা মিলেমিশে; সে প্রকৃতিকে যখন স্বার্থপরের মতো হিংস্রভাবে একাই দখলে নিয়েছে মানুষ, তখন এক ভয়ংকর অনুজীবের আক্রমণ দিয়ে প্রকৃতিই ঘরবন্দি করেছে তাদের। করোনাভাইরাসে যখন ইমারতবন্দি মানুষের কান্না; তখন প্রকৃতিজুড়ে বয়ে গেছে আনন্দের বন্যা। মানুষের নীরবতায় রাজধানীর ভবনগুলো যেন সমাধিক্ষেত্র। অন্যদিকে ঢাকার বাতাসে কমে গেছে কার্বন, সীসার দূষণ। উদ্যানে উদ্যানে প্রাণ পেয়েছে অন্যজীবেরা। প্রকৃতিকে ক্ষতবিক্ষত করে মানুষ নিজেদের বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বিনষ্ট করছে অন্যদের বাসযোগ্যতাও। মানুষ বুঝছে না, এ পৃথিবী তাদের একার নয়। এখানে আছে হাজারো প্রাণের সম্মিলন। করোনার এ বন্দিদশায় হয়তো পুরো বিশ্বের পর্যটন মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু প্রাণ পেয়েছে পর্যটনের চিত্তাকর্ষন স্থানগুলো। ডলফিনেরা ফিরছে সমুদ্র কিনারে। অথচ মানুষই নষ্ট করেছিল সমুদ্রের পরিবেশ। গবেষকরা বলছেন, সাগর-মহাসাগরের প্রতি ১ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে ১০০ গ্রাম ওজনের মানুষের নিক্ষিপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য। কি ভয়াবহ অসচেতনতায় মানুষ নষ্ট করেছে মাছেদের সংসার।

মৃত্যুর কোরাস আর শব যাত্রায় করোনাভাইরাসের এমন থাবা কারো কাম্য নয়। তবে এ ঘটনা মানুষের জন্য কঠোর সংবাদ দিয়ে গেছে। পৃথীবিটা মানুষের একার বসবাসের জন্য নয়। সব প্রাণেরই আছে অধিকার তাতে। করোনা পরবর্তী জীবনে আমরা পৃথীবিটাকে আবারো যেন বিষময় করে না তুলি। একটি সুন্দর প্রকৃতি বিনির্মাণে সবাই ব্রতী হই। বুঝতে শিখি, প্রকৃতি বাঁচলেই বাঁচবে মানুষ। করোনা শিক্ষা থেকে শিক্ষিত হই আবার। যেন স্নিগ্ধ বাতাসে ধান শালিখের উড়াওড়ি দেখতে দেখতে সোমেশ্বরী নদীর তীরে জেগে ওঠা চন্দন কাঠের বনে শুয়ে একদিন দিতে পারি নিরাপদ ঘুম।

লেখক : সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, এনটিভি

যাদুকাটা নদীর কান্না, নব্য পুঁজিপতিদের উল্লাস
স্টিল বিল্ডিং শিল্পে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানি বন্ধের দাবি এসবিএমএ'র

আপনার মতামত লিখুন