শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

বিশ্বপরিবেশ ও আমরা

মো. গোলাম মাওলা
১৬ জুন ২০২০

সম্ভবত মাধ্যমিক স্তরের কোন এক শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে অভিযোজনের বিষয়ে ধারণা পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পেয়েছিলাম বিবর্তনের ধারণা।

মহাবিশ্ব সৃষ্টি থেকেই বিশ্বের সকল কিছুই প্রয়োজনের নিরিখে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে সচেষ্ট। এই খাপ খাইয়ে চলার নামই অভিযোজন। আবার ডারউইনের মতো বিজ্ঞানীরা একে বিবর্তন বলেও অভিহিত করেছেন।

পারস্য দার্শনিক ও বিজ্ঞানী নাসির উদ্দীন তুসি- যিনি খাজা নাজিম উদ্দিন নামেও পরিচিত, তিনি ডারউইনের প্রায় ৬০০ বছর আগেই বিবর্তনের মৌলিক কিছু বিষয়ে ধারণা দিয়েছিলেন। তবে ডারউইন ও তুসির বিবর্তন ধারণার মধ্যে পার্থক্য আছে। বিজ্ঞানী তুসি মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও ক্রমবিবর্তনের উপর গুরুত্বারোপ করেন, যেখানে ডারউইন তত্ত্বের আলোচ্য বিষয় ছিল প্রাণির বিবর্তন নিয়ে।

তুসির মতে, সৃষ্টির শুরুতে মহাবিশ্ব যেসকল পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়, নানা কারণে তা পরিবর্তন হয়ে মহাবিশ্বের বিবর্তন হতে থাকে। আর পরিবর্তিত প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতেই প্রাণিকে অভিযোজিত হতে হয়েছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব তথা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে প্রাণিকূলকে তাদের আচার-আচরণ, চালচলন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পরিবেশের ভিন্নতার কারণে অঞ্চলভেদে মানবজাতিসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবনধারণের ধরনেও ভিন্নতা রয়েছে। তুসির মতে, পৃথিবীতে তিন ধরনের জীব রয়েছে- মানব, বৃক্ষ ও অন্যান্য প্রাণি। এইসব জীব টিকে থাকার প্রয়োজনে নিজেদের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে। মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য মানুষকে অন্য সকল জীব থেকে আলাদা করলেও মানুষের মধ্যে বৃক্ষ ও প্রাণিকূলের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মানুষের স্বভাব এখনো নিম্নশ্রেণীর প্রাণির সাথে কম-বেশি সম্পর্কযুক্ত। জ্ঞান ও ক্ষমতার মাধ্যমে মানুষ ক্রমে ক্রমে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বের পরিশুদ্ধতা অর্জন করে থাকে।

জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক ধারায় প্রতিবন্ধক হচ্ছে দুর্যোগ। দুর্যোগের প্রভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, প্রাণের বিনাশ, এমনকি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ও ঘটে যায়। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের সাধ্যের বাইরে। তবে সব ধরনের দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি হতে কিছুটা রেহাই পেতে বা ক্ষয়ক্ষতি লাঘবের কিছু উপায় রয়েছে- পূর্বপ্রস্তুতি, সতর্কতা বা সাবধানতা অবলম্বন।

দুই.

মহামহিম স্রষ্টা একমাত্র মানুষকেই জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। মানুষ স্রষ্টাপ্রদত্ত জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা দিয়ে অনেক দুঃসাধ্য সাধন করেছে। এভাবেই স্রষ্টার ইচ্ছায় যুগে যুগে মানব কল্যাণে অনেক নব আবিষ্কার হতে থাকবে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানুষের বসতি স্থাপনের শুরু থেকে অদ্যাবধি মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি ব্যবহার করে পরিবর্তিত পরিবেশে অভিযোজিত হতে হতে টিকে আছে। অবস্থার প্রেক্ষিতে টিকে থাকার জন্য মানুষকে গিরগিটির মতোই বদলাতে হবে। অর্থাৎ প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য মানুষ নিজেদেরকে পরিবেশ অনুযায়ী পাল্টে ফেলবে। শুরু থেকেই মানুষ প্রকৃতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েই ক্রমে অভিযোজিত হয়ে টিকে রয়েছে। কিন্তু আজ আমরা নিজেরাই প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে মূলত নিজেদের ধ্বংসকেই ত্বরান্বিত করে চলেছি।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সাবধানতা অবলম্বন করে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও হ্রাস করা যায়। কিন্তু সাবধানতার অর্থ এই নয় যে, নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করা, সম্প্রীতি বিনষ্ট করা, মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেয়া। বরং দুর্যোগকালীন পারষ্পরিক সহযোগিতা, সম্মিলিত পরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক পরিস্থিতি মোকাবেলা করাই মানুষের কাজ।

তিন.

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলমান মহাদুর্যোগ- করোনা ভাইরাস। টিকে থাকার জন্য Social Distance বা সামাজিক দূরত্বকে প্রধান উপায় হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। আমি মনে করি, এটি একেবারেই ভুল বার্তা। সামাজিক দূরত্ব নয়, আমাদের প্রয়োজন ছিল সামাজিক সতর্কতা। Social Distance এর বিপরীতে আমাদের নিশ্চিত করা উচিত ছিল Physical Distance. এই ভুল বার্তার ফলশ্রুতি কী? মানুষের মাঝে সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, রক্তের বন্ধন অগ্রাহ্য হয়েছে, হচ্ছে। কেবল নিজে টিকিয়ে রাখতে মানুষ নিষ্ঠুরতার চরম শিখরে উঠে যাচ্ছে। মৃত মানুষের সৎকারে বাধাগ্রস্ত করা কিংবা করোনা আক্রান্তকে অবহেলার বিষয়গুলো এখন যেন স্বাভাবিক। বরং তারচেয়েও নৃশংস হয়ে উঠছে মানুষ। পরিবারের আক্রান্ত সদস্যকে বন্দি করে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলা হচ্ছে! পরিবর্তিত পরিবেশে টিকে থাকার বদলে মানুষ নিজের ধ্বংসকেই আরো ত্বরান্বিত করছে।

মানবিক মূল্যবোধ আজ নির্বাসিত। নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে মানুষ ক্রমশ ফিরে যাচ্ছে পশুত্বের কাতারে। অথবা মানবজাতি আজও মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারেনি বলেই বর্ণবাদের গণ্ডি পেরোতে পারেনি; সাদার বুটের তলায় পিষ্টে ছটফট করে মরে যাচ্ছে কালোর প্রাণ! সীমাহীন লোভ-লালসা, কেবল নিজে ভালো থাকার এই অপচেষ্টা প্রকৃতির নীতিবিরুদ্ধ।

পরিশিষ্টঃ

"বিশ্বজগত দেখবো আমি

আপন হাতের মুঠোয় পুরে।"

বিজ্ঞান ক্রমশ এগিয়েছে; নজরুলের স্বপ্নেরই যেন বাস্তবায়ন হচ্ছে যুগে যুগে। বৈশ্বিক-মহাবৈশ্বিক দূরত্ব কমে গেছে। চরম উৎকর্ষতার যুগে দ্রুত প্রবেশ করে চলেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। সবকিছুই যখন মানুষের হাতের নাগালে, ঠিক সেসময় করোনার মতো অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক অনুজীবের প্রভাবে আজ সব যেন স্থবির হয়ে গেল। এই সংকটকে আরো অগ্রসর করে দিতে ভূমিকা রাখছে এই মানবকূল! অথচ আমাদের প্রয়োজন- অভিযোজন বা বিবর্তনের এই ধারায় নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা, ঐক্য। আমাদের প্রয়োজন মানবিকতার উন্নয়ন, পারষ্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির দৃঢ়তা, হিংসা-বর্ণবাদ পরিহার করে লোভ-লালসার লাগামকে টেনে ধরা। দুঃখজনকভাবে আমরা হাঁটছি উল্টো পথে!

'মানুষ মানুষের জন্য'।

এই শ্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই পশুত্বকে জয় করা জরুরি। আসুন, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করি।

লেখক: সাবেক কৃষি প্রোগ্রাম অফিসার, এমসিসি এবং  উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা

করোনায় ২০৮ কোটি টাকার ত্রাণ দিয়েছে এনজিও: এডাব
পর্যটনে করোনার ধাক্কা!

আপনার মতামত লিখুন