শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

পর্যটনে করোনার ধাক্কা!

ড. মো. কামাল উদ্দিন
১৬ জুন ২০২০

পর্যটন একটি দেশের সর্বাধিক সমৃদ্ধশালী খাত। যা কেবল অর্থনৈতিক বিকাশের কারণেই নয় বরং আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের বহুমাত্রিক সুযোগ উন্মুক্ত করে। বিশ্ব পর্যটন সম্পর্কে ম্যানিলা ঘোষণাপত্রে (১৯৮০) উল্লেখ করা হয় যে, পর্যটন কোনো দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক ক্ষেত্র এবং তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে।পর্যটনটনের কার্যকারিতা ও অস্তিত্ব বিশ্বায়নের সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। যেহেতু এটি চলমান প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আঞ্চলিক আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো যোগাযোগ ও বাণিজ্যের একটি বিশ্বব্যবস্থার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংহত করা হয়। 

যদিও করোনভাইরাস (COVID-19) মহামারী সর্বপ্রথম এবং সর্বাগ্রে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে একটি মানবিক ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এটি পর্যটন খাতের জন্য খুবই স্পষ্ট প্রভাব ফেলে। করোনভাইরাস (COVID-19) মহামারী পর্যটন শিল্পে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে, যা পর্যটন অর্থনীতিতে একটি অভূতপূর্ব সংকট সৃষ্টি করেছে। 

অনুমান করা হয় যে, ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটন প্রায় ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যে শহরগুলো পর্যটনের ফলে লোকে লোকারণ্য থাকতো, সেখানে এখন শুনশান নিরবতা। প্রাকৃতিক বিভিন্ন পশু পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে আনন্দে। অন্যদিকে পুরো পর্যটন বাস্তুসংস্থান জুড়ে সঙ্কটের প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। পর্যটন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। 

ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (ইউএনডব্লিউটিও) এর মতে, করোনা ভাইরাসের ফলে ২০২০ সালে পর্যটন খাত ৫০% থেকে ৭০% সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। এটি বিদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর জন্য একটি কঠিন বার্তা। ভবিষ্যতে ভ্রমণ সম্পর্কে আরও সতর্ক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভ্রমণকারীদের আচরণের ওপর একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আসতে পারে। ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ খাতে ৫ মিলিয়নের অধিক মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। 

এই অনুমানটি আমাদের দেশের জন্য আরও বেশি উদ্বেগজনক, কারণ আমাদের জনসংখ্যার একটি দুর্বল অংশ এই খাতের সঙ্গে জড়িত। কিছু দেশ এই ক্ষেত্রের ওপর উচ্চ নির্ভরতার কারণে অন্যদের তুলনায় আরও বেশি আঘাতের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। বিশেষত ফ্রান্স, স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, তুরস্ক, মেক্সিকো, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং থাইল্যান্ডে পর্যটন সংক্রান্ত অর্থনৈতিক ধাক্কা আরও বাড়বে। সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুসারে, এশিয়ায় ২০২০ সালে ভ্রমণ ও পর্যটন আয় সর্বাধিক হ্রাস পাবে। যেখানে ইউরোপে পর্যটন শিল্পে প্রায় ১৩ মিলিয়ন লোকের হয়েছে, সেখানে প্রতি মাসে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার উপার্জন হ্রাস পেয়েছে। ইতালি ও স্পেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

যদিও বাংলাদেশ বিশ্বের পর্যটন শিল্পের শীর্ষ দেশের তালিকায় নেই তবুও বাংলাদেশের মানুষের কর্মসংস্থান, দেশীয় অর্থনীতির গতিশীলতা এবং বিদেশি অর্থ উপার্জনের জন্য এ খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাস বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে কি পরিবর্তন এনেছে তা দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশের পর্যটনে করোনভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি কয়েক সপ্তাহ পরে প্রকাশিত হতে শুরু করে। পর্যটকদের ছাড়াই দেশের দুটি সমুদ্র সৈকতের দুর্দশার চিত্র ইতোমধ্যে গণমাধ্যম তুলে ধরেছে। ট্যুর অপারেটররা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে একটি স্বচ্ছ ভবিষ্যতের পূর্বাভাসের জন্য। হোটেল এবং মোটেল মালিকদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বাতিল ও বন্ধ থাকায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। মানুষ প্রায় ভুলতেই চলেছে যে পরিবার নিয়ে বেড়ানোর কথা। সকলের মনে একটি চিন্তা কীভাবে করোনামুক্ত থাকা যায়, কীভাবে বেঁচে থাকা যায়। বিদেশি পর্যটকদের ভিসা আপাতত স্থগিত রয়েছে। এই চরম হতাশাজনক ভীতিকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট গুলো যেমন কক্সবাজার, পতেঙ্গা, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং পর্যটন রিসোর্টগুলোতে রয়েছে সুনসান নীরবতা, নেই কোন জনমানবের বিচরণ। এ স্থানগুলোতে প্রকৃতি যেন আপন মনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। প্রাকৃতিক প্রাণীগুলো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই। নেই কোনো ময়লা আবর্জনার স্তূপ, এ গুলোতে নেই কোন বায়ু দূষণ। বৃহত্তর সিলেট ও মৌলভীবাজারের সাইটগুলোও পর্যটকহীন নির্জনপুরী। এই অবস্থায় ট্যুর অপারেটররা সত্যিকারের খারাপ সময় পার করছে। 

আশঙ্কা করা হচ্ছে, COVID 19 পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে খাতটি তার স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসতে কয়েক বছর সময় নিতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশ যখনই পর্যটন খাতকে একটি আকর্ষণীয় খাতে রূপান্তর করছিল ও বিদেশি পর্যটকরাও এ দেশে ভ্রমণ করতে শুরু করেছিলেন, ঠিক সে সময়ে করোনাভাইরাসের মতো একটি মহামারীর ধাক্কা বাংলাদেশের পর্যটন খাতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনা পরবর্তী সময়ে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও হয়তো নিরাপদ ভ্রমণের জন্য নতুন স্বাস্থ্য প্রোটোকল প্রয়োগ করা এবং ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে। এই খাতে স্থায়ী কিছু বিষয় চলে আসবে আগামী দিনগুলোতে যেমন ভ্রমণকারীদের আস্থার পুনরুদ্ধার, এই সেক্টরের জন্য নতুন নিরাপদ ভ্রমণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, দর্শনার্থীদের জন্য তথ্য দিয়ে সহায়তা ও তাদের আচরণ পরিবর্তন করে এ সেক্টরকে পুনরুদ্ধার করা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এই পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য, তবে পর্যটন অর্থনীতিকে সফলভাবে পুনরায় চালু করতে আরও অনেক কিছু সমন্বিত উপায়ে করা দরকার, কারণ পর্যটন পরিষেবাগুলো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ভ্রমণ, পর্যটন শিল্প, সরকার, ব্যবসায়ী ও এ সেক্টরের শ্রমিকদের সাথে সমন্বয় করে শক্তিশালী একটি কার্যকর পরিকল্পনা এখনই করতে হবে। টিকিয়ে রাখতে হবে আমাদের পর্যটন শিল্প।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্বপরিবেশ ও আমরা
নিস্তব্ধ ধানমন্ডি লেকের নতুন রূপ

আপনার মতামত লিখুন