বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

পর্যটন ভাবনা: মালদ্বীপ পারলে আমরা পারবো না কেন?

ড. জেবউননেছা
০৮ নভেম্বর ২০২২

সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়ানো মানুষ আমি। তাই সাগরের ডাকে সাড়া দিয়ে গিয়েছিলাম এশিয়ার সবচেয়ে ছোট  ও বিশ্বের অন্যতম নিচু দেশ মালদ্বীপে। মালদ্বীপ যাওয়ার উদ্দেশে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গাড়ি থেকে নামার পরই চোখ আটকে গেলো দুই জন মানুষের দিকে। দু’জনে জড়িয়ে কাঁদছেন। হয়তো দুই ভাই হবে। ইমিগ্রেশনে গিয়ে আবারও একই দৃশ্য, স্ত্রীর চোখে গড়িয়ে পড়ছে পানি। স্বামী যাচ্ছে মালদ্বীপ জীবিকার উদ্দেশ্যে। বিমানে ওঠার আগে দেখি প্রায় সবার হাতেই মিষ্টির প্যাকেট। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, রেস্তোরাঁর মালিকের জন্য  মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছেন। বিমান থেকে নামতেই একটু এগিয়ে দেখি প্রতিটি দ্বীপের জন্য আলাদা বুথ। এছাড়াও রয়েছে সি প্লেনের ব্যবস্থা। আমাদের উদ্দেশ্য মাফুসি আইল্যান্ড। হোটেলের বুথ থেকে এক মিনিটের ব্যবধানে স্পিডবোটের ঘাট।

আমাদের স্পিডবোটে তোলা হলো। নীল জলের উত্তাল ঢেউয়ের গর্জনে আত্মা কেঁপে উঠেছিল কয়েকবার। প্রায় ৩৫ মিনিট স্পিডবোটের যাত্রা শেষে মাফুসি স্পিডবোট ঘাট। সেখানে সাদা রঙের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন কয়জন। তারা আমাদের অভ্যর্থনা জানান। এখানে একটি বিষয় বলা হয়নি। প্রায় প্রতিটি হোটেলের নিজস্ব স্পিডবোট আছে। প্রতিটি বোটে কমপক্ষে ৩০ জনের কাছাকাছি বসা যায়।

যাহোক, হোটেলের লবিতে আমাদের দেওয়া হলো আপেলের শরবত। হোটেলের একজন এসে আমাদের বলছিলেন, হোটেল থেকে বিভিন্ন রকমের প্যাকেজ আছে। যেমন, জেসকি করা, প্যারাসাইলিং করা, ডলফিনের অভয়ারণ্য দেখা, গভীর সমুদ্রবন্দরে গিয়ে মাছ শিকার, প্রাইভেট আইল্যান্ড পরিদর্শন ছাড়া আরও অনেক কিছু। আমরা বিকালে বেরিয়ে শিপে চড়ে চলে গেলাম গভীর সমুদ্রে। মজার ব্যাপার, শিপে জুতা পরে ওঠা যাবে না। যাত্রীদের জুতো একটি বক্সে রেখে শিপে উঠতে হয়। শিপে দেখা হলো বাংলাদেশি একজন প্রবাসীর সঙ্গে, বাড়ি সিলেটে। তিনি দেশে মাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পাঠান হুন্ডির মাধ্যমে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, অন্যান্য বাংলাদেশিরা টাকা কী করে পাঠান। তিনি বললেন, বেশিরভাগ প্রবাসী এভাবেই পাঠান। কথাটি শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো। যাহোক, বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ খুঁজলাম। উদ্দেশ্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। হোটেলে গিয়ে দেখি এক টুকরো বাংলাদেশ। রেস্তোরাঁ মালিক সেও বাংলাদেশি। জানতে চাইলে বললেন, মাসিক চুক্তিতে বহু বাংলাদেশি শ্রমিক তার রেস্তোরাঁয় সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার সারেন। আমাদের হোটেলে ফিরে দেখলাম হোটেলের প্রধান ফটকের সামনে একটি মাটির মটকা। একটি লাঠিতে নারকেলের খোল বাঁধা। হোটেলে প্রবেশের সময় কারও পায়ে বালি থাকলে সেই বালি পানি দিয়ে ধুয়ে হোটেলে প্রবেশ করতে হয়। হোটেলের রেস্তোরাঁয় দেখা মিললো কয়েকজন বাংলাদেশির, যারা কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত, কেউ হোটেল বয়। শুধু বাংলাদেশি নয়, পেলাম বিভিন্ন দেশের মানুষও।

সাগর পাড়ে পরিচিত হলাম বিভিন্ন দেশের পর্যটকের সঙ্গে, যারা রাশিয়া, ভারত, কসাভো, সার্বিয়া, হন্ডুরাস, জার্মানি, কিরগিজিস্তান, গ্রিস, স্লোভেনিয়া, সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কি জানো বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশে? তাদের সবাই একবাক্যে বলেছেন জানেন না। বিষয়টি আমাকে মর্মাহত করেছিল। আমি তাদের বলেছি বাংলাদেশে বেড়াতে আসতে। যেখানে পর্যটন ব্যয় কম এবং ডলারে লেনদেন হয় না। মালদ্বীপে ডলারে লেনদেন হয় এবং ভীষণ ব্যয়বহুল। তাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশে আসবে। ছোট দ্বীপটিতে হেঁটেছি কয়েকবার, কোনও স্থানে ময়লা দেখিনি। একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দ্বীপ এত পরিচ্ছন্ন কী করে। সে বলেছিল, এদেশে নিজ নিজ বাড়ির আঙিনা নিজেরাই পরিষ্কার রাখেন। রাস্তা খুবই প্রশস্ত, কারণ সবাই জায়গা ছেড়ে বাড়ি করে। সে জানালো, মাফুসি আইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় হোটেলের মালিক এখন তার নিজ হোটেলের রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। আমি বললাম কী করে সম্ভব? তিনি বললেন, এখানকার মানুষেরা সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং তার বাড়ি খুবই ছোট। সে জানালো, এখানকার মালিকেরা কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন না। জানতে চাইলাম তুমি দেশে কী করে টাকা পাঠাও? তার উত্তর ছিল হুন্ডির মাধ্যমে। সে জানালো যারা কোম্পানির মাধ্যমে আসেন, তারা মারা গেলে তাদের  লাশ বাংলাদেশে যায়। আর বাকিদের এখানেই কবর দেওয়া হয়। বহু বাংলাদেশির কবর আছে এই দেশে। এই দ্বীপে একটি কারাগার আছে, যেখানে বহু বাংলাদেশি বন্দি আছে নানা অপরাধে। শুধু কি তাই? মালদ্বীপের স্থানীয়দের সন্তানেরা বিপথে গেলে তাদের শোধরানোর জন্য বাবা-মা কারাগারে পাঠান সন্তানকে।

পরদিন খুব সকালে অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় সাড়ে ৪টায় ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বারান্দায় গিয়ে দেখি হোটেলের ঝাড়ুদাররা ঝাড় দিচ্ছেন। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতে সব ঝকঝকে তকতকে। নাস্তা সেরে আর একটি দ্বীপ সান সিয়াম ওলেভিলির পথে যাত্রা। স্পিডবোটে বিশ মিনিটের যাত্রা শেষে সান সিয়াম ওলেভিলি আইল্যান্ড। মন জুড়ানো প্রাণ জুড়ানো সৌন্দর্য যেন এই দ্বীপে। সন্ধ্যায় মাফুসি দ্বীপে সাগরের কাছে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনে সংগীত উপভোগ। সাগরপাড়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির গানের সাথে সবার আনন্দ।

সাগরপাড়ে বড় পর্দায় চলচ্চিত্র পরিদর্শন। দ্বীপের পথে পথে ওয়াটার স্পোর্টসের দোকান, দ্বীপের মাঝে মাঝে দোলনা ঝোলানোসহ নানা রকমের আনন্দ আয়োজন যেন দ্বীপটিতে। কোথাও কোন শোরগোল নেই, ইভটিজিং নেই। নির্বিঘ্নে ইউরোপিয়ানরা চলাফেরা করেন। কেউ তা দেখে ভ্রু কুঁচকান না। সাগর পাড়ের জুসের দোকানে পাওয়া গেলো বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিক। তাদের সাথে কথা বলতেই তারা বলেন, তারা দেশকে ভালোবাসেন কিন্তু দেশের প্রচলিত নানা রকমের অনিয়ম তাদের ভালো লাগে না। অনেক প্রবাসী দুঃখ করে বলেন, এত টাকা পাঠাই দেশে, তারপরও স্বজনদের মন ভরাতে পারি না। একজন তার  মুঠোফোনে দেখালেন, বাংলাদেশে তার গ্রামে বাড়ির কাজ চলছে। তার স্বপ্ন একটি বাড়ি হবে, তারপর সে বিয়ে করবে। এমন আরও অনেক স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে একসময় যেন তাদের আপনজন হয়ে যাই।

কয়দিন  দ্বীপে  হাঁটতে হাঁটতে বহু বাংলাদেশির সাথে কথা হয়েছে। তারা কেউ নির্মাণশ্রমিক, কেউ হোটেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করে, কেউ জুস বানায়, কেউ কেউ দোকানে বসে। মালদ্বীপই যেন তাদের ঘরবাড়ি। একজন প্রবাসী বাংলাদেশি বললেন, নামাজের সময় যদি মসজিদে যান, দেখবেন বেশিরভাগ মুসল্লি বাংলাদেশি। বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর মালিক বলেছিলেন, হোটেলে যদি দ্বীপের কাউন্সিলর এসে ময়লা দেখেন তখন জরিমানা করেন। এজন্য আমরা হোটেল সবসময় পরিষ্কার রাখি। এমন আরও কত শত কথা তাদের সাথে হয়েছে। যেদিন ফিরে যাবো সেদিন পথে পথে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাথে দেখা হয়েছে। তারা বলেছে, আপা আবার আসবেন বেড়াতে। আমি কথা দিয়ে এসেছি আবার যাবো। কেন যেন মন বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছিল। মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় কোনও আপন মানুষদের ফেলে যাচ্ছি। দেশ আর দেশের মাটির সন্তান এতটা আবেগের হতে পারে সেদিন নতুন করে বুঝতে পেরেছিলাম।

স্পিডবোটে ওঠার পর যতক্ষণ চোখ যায় ততক্ষণ তারা হাত নেড়ে বিদায় দিয়েছে। একসময় দেখি আমার চোখের কোণায় পানি চলে এসেছে। এরাই আত্মীয়স্বজনকে রেখে, আবেগচাপা দিয়ে, বুকে পাথর বেঁধে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। ৩৫ মিনিটের স্পিডবোটের ভ্রমণ শেষে বিমানবন্দরে এসে যখন দাঁড়ালাম, তখন দেখা হলো আর একজন বাংলাদেশির সাথে । যিনি রাজধানী মালেতে কাপড়ের ব্যবসা করেন, ৩০ বছর ধরে। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে  বিমানে বসে শুধু একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকি, মালদ্বীপ যদি পানি দিয়ে এত আয় করতে পারে, তাহলে আমার দেশে পাহাড়, সমুদ্র, নদী, হাওর-বাঁওড়, সুন্দরবনসহ  আরও কত কি আছে। তাহলে কেন আমার দেশে  বিদেশি পর্যটক আসে না? তাহলে কি প্রচার প্রচারণার অভাব? নাকি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব? মনের অজান্তে কল্পনা করতে থাকি।

একদিন কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে, সেখানে থাকবে সি প্লেন, স্পিডবোট। সেই যানবাহনে পর্যটকেরা চলে যাবেন সেন্টমার্টিন। দ্বীপ হবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বিদেশিদের জন্য আলাদা থাকবে বিচ। মালদ্বীপ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হয়ে ইউরোপিয়ানদের জন্য নিরাপদ পর্যটন এলাকা হলে আমার দেশে নয় কেন? মালদ্বীপের সমুদ্রকে রক্ষার জন্য  তাদের সাগর পাড় রক্ষার জন্য দেখেছি বড় বড় পাথর দিয়ে তারা আটকে দিয়েছে সমুদ্রের ঢেউ। কোথাও দেখেছি সমুদ্র তলদেশ থেকে মাটি আরোহণ করতে। কতটা পর্যটনবান্ধব দেশ হলে এমন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে পারেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে একটা বিষয় জানতে পেরে মনটা আনন্দে ভরে ওঠার সাথে সাথেই ক্রমশ মলিন হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু চর কুকরিমুকরিকে একটা দ্বীপ পর্যটন এলাকা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু হায়েনার দল তাকে বাঁচতে দিলো না। নানা প্রকার ফুল, ফল ও অর্থকরী গাছ লাগাতে বলেছিলেন। সাগরের বালুকাময় বিরানভূমিতে ঝাউ, নারকেল, সুপারি গাছ লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। পর্যটনের বীজ তো বপন হয়েছে তখন থেকেই। শুধু দরকার এই বীজ পরিচর্যার জন্য সততা, জবাবদিহি। কক্সবাজারের হোটেল মোটেলগুলোতে অতিরিক্ত মূল্য হাঁকানো বন্ধ করা, শহরে রিকশা, গাড়ির জন্য আলাদা লেন করা, পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, সাগর পাড়ে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা। সাগরপাড়ে  কাঠের না হয়ে প্লাস্টিকের তৈরি চেয়ার স্থাপন করা এবং নতুন নতুন আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে বিদেশি পর্যটক বৃদ্ধি পাবে।

আমি ভীষণভাবে দেশকে নিয়ে ইতিবাচক স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। সেই ভালোবাসা থেকে বিশ্বাস, একদিন বাংলাদেশ হবে পর্যটনের পীঠস্থান। উন্নত ব্যবস্থা, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় দায়িত্ব প্রদান এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটনের মাধ্যমে একদিন  বাংলাদেশে বাড়বে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা।

লেখাটি যখন শেষ পর্যায়ে তখন চোখের সামনে মালদ্বীপের মাফুসি দ্বীপের প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইদের চেহারা চোখে ভাসছে। মনে হচ্ছে তারা দূর থেকে বলছেন, রেমিট্যান্সদাতা হিসেবে আমাদের মূল্যায়ন করুন, আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে চাই, হুন্ডির মাধ্যমে নয়। এ বিষয় নিয়ে কিছু করুন।

বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকাকে নিজেদের স্বচ্ছতা এবং পবিত্রতা দিয়ে পতাকাকে সমুন্নত রাখুন।  

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্বকাপ উপলক্ষে ওয়ালটন টিভিতে হট সেল ক্যাম্পেইন
কলকাতায় যে কারণে বাড়ছে বাংলাদেশি পর্যটক

আপনার মতামত লিখুন