ক্ষেতভরা তরমুজের গাছ ফলনে সর্বনাশ
নোয়াখালীর সুর্বণচরের তরমুজকে দেশসেরা আখ্যা দিয়ে থাকেন
অনেকে। কারণ সুবর্ণচরের পলিমাটির তরমুজ দেখতে
খুবই সুন্দর,
খেতে মিষ্টি ও স্বাদে
হয় অতুলনীয়। সুবর্ণচরে পাইকারি তরমুজ কিনতে আসেন।
এবার সুবর্ণচরের সাতাইশদ্রোন গ্রামে তরমুজ গাছে ক্ষেত ভরা থাকলেও ফলন নেই। এর জন্য অজ্ঞাত রোগকে দায়ী করছেন চাষীরা। এজন্য এবার ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।
প্রতি বছর মার্চ মাসের শেষের দিকে এবং এপ্রিলে সুবর্ণচর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে তরমুজ ব্যবসায়ীদের সারি সারি ট্রাক দেখা গেলেও এ বছর ভিন্ন চিত্র নজরে পড়েছে। মাঠে তরমুজের সবুজ গাছে ভরপুর কিন্তু ফলন নেই। এর ফলে তরমুজ চাষে লাখ লাখ টাকা পূঁজি বিনিয়োগ করে পথে বসার উপক্রম হয়েছে চাষিদের।
সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর সুবর্ণচরে ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। গত বছর এই উপজেলায় তরমুজের আবাদ ছিল ১ হাজার ৩৯৭ হেক্টর।
সুবর্ণচরের তরমুজ চাষিরা জানান, তরমুজ গাছের ডগা জ্বলে যাচ্ছে ও গোঁড়ায় পচন রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। ফলে গাছ মরে গিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনো ফলন নেই।
গত বুধবার সুবর্ণচর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কমপক্ষে ৬ জন তরমুজ চাষির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য গেছে।
চলতি বছর উপজেলার চর আমানউল্যা ইউনিয়নের
চরবজলুল করিম এলাকায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের ফলন বিপর্যয় হয়েছে।
সুবর্ণচরের চর আমানউল্যা ইউনিয়নের সাতাশদ্রোন গ্রামের তরমুজ চাষি ইব্রাহিম খলিল জানান, গত বছর তিনি ৯৬০ শতক (৬ কানি) জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলেন। চাষের খরচ বাদ দিয়ে ভালো লাভ হয়েছিল। গত বছর ফলন ভালো ও লাভ হওয়ায় তিনি চলতি বছর ১ হাজার ৯২০ শতক (১২ কানি) জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন।
তিনি বলেন, 'সবুজ তরমুজ গাছে খেত ভরে থাকলেও ফলন নেই। গত ২০-২৫ দিন ধরে তরমুজ খেতে অজ্ঞাত রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এ রোগে সবুজ গাছের ডগা জ্বলে যাচ্ছে এবং গোঁড়া কালো হয়ে পচে যাচ্ছে। কীটনাশক প্রয়োগ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।'
চলতি বছর বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হবেন বলে হতাশা ব্যক্ত করে এই চাষি জানান, প্রতি কানি জমি ভূমি মালিকের কাছ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ৬ মাসের জন্য ইজারা নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন। এতে প্রতি কানিতে প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
ইব্রাহিম খলিল বলেন, 'বিভিন্ন এনজিও ও মহাজন থেকে ৪ লাখ টাকা ঋণ এবং নিজের জমানো টাকা দিয়ে তরমুজ চাষ করেছি। কিন্তু তরমুজের ফলন না হওয়ায় চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছি। তরমুজ গাছগুলোর বয়স ৭৫ থেকে ৮০ দিন। গাছে গাছে ফুলও ফুটেছে। কিন্তু তরমুজ ধরছে না এবং অজ্ঞাত রোগ রাতারাতি খেতে ছড়িয়ে পড়ছে কিন্তু, কৃষি অধিদপ্তরের লোকজন এসে কোনো পরামর্শ দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।'
চর আমানউল্যাহ ইউনিয়নের তরমুজ চাষি মো. রাসেল ৪৮০ শতক জমিতে ৩ লাখ টাকা খরচ করে তরমুজ চাষ করেছেন।
তিনি আরো বলেন, 'খেতে গাছ আছে, তরমুজ নেই।' এতে এনজিওর ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। একই ধরনের কথা শোনালেন অপর তরমুজ চাষি আকরাম হোসেন ও বেলাল খান।
চাষি ইব্রাহিম খলিলসহ অন্যান্য তরমুজ চাষিরা ফলন বিপর্যয়ের জন্য অজ্ঞাত রোগের পাশাপাশি ফসলের মাঠের পাশে অবস্থিত ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়া ও মাঠ থেকে প্রতি বছর টপ সয়েল কেটে ইটভাটায় নেওয়াকে দায়ী করেছেন।
তরমুজ চাষি মো. রাসেল বলেন, 'সুবর্ণচরের চর আমানউল্যাহ ইউনিয়নে ৯টি ইটভাটা রয়েছে। তার মধ্যে সাতাশদ্রোন গ্রামেই আছে ৪টি। এই ইটভাটাগুলোর দুষিত কালো ধোঁয়ার কারণেই মাঠের সবুজ ফসল নষ্ট হয়ে কৃষকদের পথে বসার উপক্রম হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।'
চাষিরা জানান, ফসল হানির জন্য ইটভাটাই মূলত দায়ী। ফসলের মাঠ এলাকা থেকে এসব অবৈধ ইটভাটা অপসারণের দাবি জানান তারা।
একই ইউনিয়নের চর বজলুল গ্রামের তরমুজ চাষি নারায়ণচন্দ্র নাথ জানান, তিনি এবার আগাম তরমুজের চাষ করেছেন। ১২০ শতক জমিতে ৯০ হাজার টাকা ব্যয় করে তরমুজ চাষ করেছেন। গত বছরের তুলনায় এবার ফলন ভালো হয়নি। তরমুজের আকার ছোট ছোট। তবে দাম বেশী।
চর বজলুল গ্রামে তরমুজ কিনতে আসা চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার পাইকারি তরমুজ ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম মহাজন বলেন, 'সুবর্ণচরের তরমুজ অন্যান্য জেলার তরমুজের চেয়ে বেশী মিষ্টি ও সুস্বাদু এবং ভেতরে লাল হওয়ায় চাহিদা বেশী। দামও ভালো পাওয়া যায়।'
তিনি জানান, প্রতি বছর তিনি চট্টগ্রাম থেকে ৭-৮টি ট্রাক নিয়ে তরমুজ কিনতে সুবর্ণচর আসেন। কিন্তু চলতি বছর তরমুজের ফলন ভালো হয়নি। দামও বেশী। তিনি দেড় কানি জমির তরমুজ কিনেছেন ৩ লাখ ১০ হাজার টাকায়।
সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হারুনুর রশিদ চলতি বছর তরমুজের ফলন বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে বলেন, 'গত বছর এই উপজেলায় তরমুজের আবাদ ছিল ১ হাজার ৩৯৭ হেক্টর। গত বছর ফলন ও লাভ বেশী হওয়ায় চলতি বছর কৃষকরা অধিক পরিমাণে তরমুজের চাষ করেছেন। লবণাক্ত ও ফলনের অনুপযুক্ত জমিতেও তরমুজ চাষ করার কারণেই ফলন বিপর্যয় হয়েছে।'
সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৈতি সর্ববিদ্যা বলেন, 'ফসলের মাঠের আশপাশে কোনো অবৈধ ইটভাটা থাকলে এবং ইটভাটার কারণে ফসল বিপর্যয় ঘটছে এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
আপনার মতামত লিখুন