শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অর্থনীতি

পর্যটন উন্নয়নের নামে চাঁদাবাজি

জাফলং থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন দেশী-বিদেশী পর্যটক

ডেস্ক রিপোর্ট
১১ মে ২০২২

দেশের অন্য পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশ ফি না নিলেও ব্যতিক্রম সিলেটের ‘পাথরকন্যা’ জাফলং পর্যটন স্পট। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় পর্যটনের উন্নয়নের নামে এখানে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি হয়। গেল বছরের ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় পর্যটকদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়া। এজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেয়া হয় স্বেচ্ছাসেবক। তাদের কাছে প্রায়ই নারী পর্যটকরা নাজেহাল হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও এসব ঘটনা আলোচনায় আসে না। 

তবে গত বৃহস্পতিবার বেড়াতে আসা নারী-পুরুষদের মারধরের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়। স্বেচ্ছাসেবক কর্তৃক লাঠি দিয়ে পর্যটকদের মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে। তাদেরই একজন লক্ষণ চন্দ্র দাস। তিনি পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এদিকে বৃহস্পতিবার হামলার ঘটনার পর জাফলংয়ে পর্যটকদের সংখ্যা কমেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সিলেট বেড়াতে আসা পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রথম পছন্দ জাফলং হলেও এখন তারা এই পর্যটন কেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ করে যারা পরিবার নিয়ে এসেছেন তারা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে জাফলংমুখী হচ্ছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সরকারিভাবে প্রকৃতিকন্যা জাফলংকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। পর্যটনের উন্নয়নে প্রবেশমূল্য নেয়া হলেও বাস্তবে জাফলংয়ে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। এ অবস্থায় ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর ২৫ সদস্যের গোয়াইনঘাট উপজেলার পর্যটন উন্নয়ন কমিটি গঠন করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে গঠিত পর্যটন উন্নয়ন কমিটিতে পেশাজীবী সংগঠনের বিভিন্ন কমিটির ৬ জন সভাপতি প্রতিনিধি ছাড়া বাকি সবাই স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও উপজেলার আওতাধীন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সদস্য। সেই কমিটির তদারকিতে সাধারণত প্রতিদিন ৮-১০ জন স্বেচ্ছাসেবক অস্থায়ী ভিত্তিতে জাফলংয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। পর্যটকদের সুবিধার্থে জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাফলংয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে ১০ টাকা হারে প্রবেশমূল্য নেয়া হয়। এই টাকা দিয়ে এলাকা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বেচ্ছাসেবকদের মজুরিসহ আগত পর্যটকদের বিভিন্ন সেবা দেয়া হয়। ঈদের সময় বা বিশেষ দিনে পর্যটকদের চাপ বাড়লে স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা ২০-৩০ জনে উন্নীত করা হয়। তাদের প্রত্যেকে ঘণ্টাপ্রতি ৫০ টাকায় কাজ করলেও তাদের সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয় না বলে জানিয়েছেন ইউএনও। একজন ম্যানেজারের মাধ্যমে তাদের রিক্রুট করা এবং ঘণ্টা হিসেবে প্রতিদিনের মজুরি দেয়া হয়। এ ছাড়া পরিছন্ন কর্মীদের দৈনিক ৪০০ টাকা হারে মজুরি দেয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, জাফলংয়ের পর্যটন উন্নয়নের নামে চাঁদা নির্ধারণের পর স্থানীয় প্রশাসন জিরো পয়েন্ট এলাকার প্রবেশপথে টিকিট কাউন্টার করে। এক সময় বল্লাঘাট এলাকা হয়ে জাফলং জিরো পয়েন্টে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন বর্তমানে গুচ্ছগ্রাম হয়ে প্রবেশপথ করেছে। গুচ্ছগ্রামে বিজিবি ক্যাম্পের পাশে বসানো হয়েছে টিকিট কাউন্টার। এখানে প্রশাসনের নিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবকরা অবস্থান করে। কাউন্টারের পাশে সাঁটানো সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে, জাফলং পর্যটন এলাকার উন্নয়ন ও পর্যটন সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেলা পর্যটন কমিটি ও উপজেলা পর্যটন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যটক প্রবেশে পর্যটকপ্রতি ১০ টাকা হারে ফি নির্ধারণ করা হলো। এই ঘোষণার নিচে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাত দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে জেলা প্রশাসক জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি এবং ইউএনও উপজেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।

স্থানীয় একটি সূত্রে জানা যায়, সাধারণত স্বেচ্ছাসেবকদের মজুরি বাবদ প্রতিদিন ৫ হাজার থেকে বিশেষ সময়ে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়। এছাড়া বিভিন্ন খাত দেখিয়ে বড় অঙ্কের টাকা খরচের অভিযোগ রয়েছে। পর্যটন এলাকার শৌচাগার সংস্কারের জন্য প্রতিবছর পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন পরিষদকে ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। জাফলংয়ে পর্যটকদের লাঠি দিয়ে মারধরকারীদের সবার গায়ে স্বেচ্ছাসেবক লেখা জ্যাকেট দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। তবে বাস্তবে স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই বখাটে বা ব্যবসায়ী বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।

ইকবাল হোসেন নামে এক স্বেচ্ছাসেবক পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক। এছাড়া তার মেসার্স এসকে এন্টারপ্রাইজ নামে একটি বালু-পাথরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ইকবালের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ইকবাল হোসেন এমন অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শুধু কাজ করেন।

জাফলংয়ের স্থানীয় গ্রিন রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী বাবলু বখত বলেন, সরকারি বিশেষ ছুটি ছাড়াও শুক্র-শনিবার হাজারো পর্যটক বেড়াতে আসেন। তবে ঈদ-পরবর্তী দিনগুলোয় প্রতিদিন লাখেরও বেশি পর্যটকের সমাগম হয়। এছাড়া অন্য দিনগুলোতে জাফলংয়ে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার পর্যটকের সমাগম হয়ে থাকে। এ হিসেবে সাধারণত প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। আর বিশেষ দিনগুলোতে ১০ লাখ টাকার মতো আয় হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ‘স্বেচ্ছাসেবক অর্থ কী?’ বলে প্রশ্ন করে বলেন, বৃহস্পতিবার তারা (স্বেচ্ছাসেবক) যে আচরণ করেছে, তাতে মনে হয়েছে এরা প্রশাসনের লাঠিয়াল। চাঁদা নিয়ে যদি প্রাকৃতিক স্থানগুলো স্থানীয়ভাবে পরিচালনা করতে হয়, তাহলে পর্যটন উন্নয়নে সরকারের কাজ কী? তিনি অভিযোগ করে বলেন, শুধু চাঁদা আদায় নয়, জাফলংয়ে খাসজমিতে প্রশাসনের মদদেই শত শত দোকান বসানো হয়েছে। এখান থেকে প্রশাসনের কর্তারা টাকা পান।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান জানিয়েছেন, জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন শুধু ফি নেয়ার বিষয় বাস্তবায়ন করছে। উপজেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি বিষয়টিকে ‘চাঁদাবাজি’ বলতে অস্বীকার করে বলেন, এর আগে জাফলংকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর এক সপ্তাহ প্রবেশ মূল্য ‘ফ্রী’ করা হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

সৌদি আরবের নতুন পর্যটন দূত মেসি
অপার সম্ভাবনার পর্যটনকেন্দ্র সোনালি বালুর সোনারচর

আপনার মতামত লিখুন