শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
দেখা থেকে লেখা

অপরূপ সোনাদিয়া দ্বীপ

নাকিব নিজাম
২৮ আগস্ট ২০২১

কক্সবাজারের দক্ষিণে অবস্থিত বাংলাদেশের এক অপূর্ব আকর্ষণ সোনাদিয়া দ্বীপের কথা। যেখানে কাটানো রাত জীবনের শ্রেষ্ঠতম রাতগুলোর মধ্যে ধরা হবে। নির্জনতায় ঘেরা একখণ্ড স্বর্গের দ্বীপ যেন সোনাদিয়া। বিশাল সমুদ্রের বুক চিরে জেগে ওঠা প্রকৃতির সতেজ ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সোনাদিয়া দ্বীপকে একাকিত্বের পরিপূর্ণ সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা কাটিয়ে ওঠার জন্য যারা নির্জনতার খোঁজে থাকেন, তাদের ভ্রমণ তৃষ্ণা, জীবনের ক্লান্তি মেটানোর জন্য এক আদর্শ জায়গা এটি। হিমেল হাওয়া আর বৃষ্টির ছিটেফোঁটা যেখানে নিয়মিত, পর্যটক সেখানে তেমনই অনিয়মিত। পর্যটকহীনতাই এই জায়গাটিকে রেখেছে এখনও পরিচ্ছন্ন, যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত এবং নিতান্তই বিশুদ্ধ পরিবেশ; যেখানে সৈকতে লাল কাঁকড়ারা আপন ছন্দে নৃত্য করে, যেখানে বাতাসের দোলায় ঝাউগাছে সৃষ্টি হয় তাদের আপন তরঙ্গ আর সমুদ্রের গগন ছোঁয়া ঢেউ যেন গোসল করতে মনে ভীতি সঞ্চার করে। সারি সারি ঝাউবনের মাঝে তাঁবু টানিয়ে অস্থায়ী বসতি তৈরি করে খাণিকের জন্য বসবাস আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে ক্ষণে ক্ষণে আকাশের রূপ বদলানো দেখতে কার না ভালো লাগে! সঙ্গে যদি ব্যবস্থা করা যায় একটি হ্যামকের, অলস দুপুরের ক্লান্ত প্রহরে এক রোমাঞ্চের জন্ম দেয়।

লিখছি চার বন্ধু নাকিব, আঞ্জুম, অনিক ও ইফফাতের সোনাদিয়া অভিযান নিয়ে। পরিকল্পনার শুরু হয় সেমিস্টার ব্রেককে কেন্দ্র করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার চাপ যখন বেশি হয়ে যাচ্ছিল, ফাইনালের পর নির্জনে কিছু সময় কাটানোর জন্য বেছে নেওয়া সোনাদিয়া ভ্রমণ; প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় স্মৃতির খাতায় যোগ করতে কিছু অতুলনীয় মুহূর্ত। আমরা অবশ্য পূর্ণিমায় যাইনি; গিয়েছিলাম ঘোর অমাবস্যায়।

এই ভ্রমণ নিয়ে এক্সাইটমেন্ট যেমন ছিল তুঙ্গে, তেমনি চেষ্টা করেছিলাম প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে উপভোগ করতে। শুক্রবার রাতের বাস ধরে শনিবার ভোরে গিয়ে পৌঁছি আমরা কাঙ্ক্ষিত সোনাদিয়ায়।

এর মধ্যে ঘটিভাঙ্গায় যতক্ষণ ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করেছি, ওই মুহূর্তটুকু বর্ণনা না করলেই নয়। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা ঘোরা হলেও কখনও এমন হয়নি- প্রবল বাতাসের বেগে সমুদ্রের পানি বৃষ্টির মতো ছিটে ছিটে গায়ে লেগেছে। ঘটিভাঙ্গা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আকাশ আর সবুজ গাছপালা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া দেখে অজান্তেই বেরিয়ে আসে চোখের সামনে যেন স্বর্গ উপস্থিত।

ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর দিয়ে খাল ভেঙে যখন আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলছিল সোনাদিয়ার উদ্দেশে, বহুবার ফিল্মের জগতের সঙ্গে তুলনা করেছি অপূর্ব পরিবেশকে। আবহাওয়া ছিল বৃষ্টিময়, তাই আরও বেশি ভালো লেগেছে।

সোনাদিয়ায় পৌঁছার পর আমাদের গাইড জসিমের বাড়িতে হাত-মুখ ধুয়ে কিছুক্ষণের জন্য দিলাম ঘুম। বেলা ১১টার দিকে গাইড সমুদ্রের ধারে যখন তাঁবু টানাতে যাবে, তখন সারারাতের বৃষ্টির চিন্তা বারবার নাড়া দিচ্ছিল। এমন সময় চোখে পড়ল কুঁড়েঘরের মতো একটি ছায়া। সেখানেই হলো আমাদের দু'দিনের অস্থায়ী বসবাস। দুই গাছে দুটো হ্যামক টানিয়ে দিয়ে চলে এলাম সমুদ্রে গোসলের জন্য। সেদিনের মতো গোসল আর করা হলো না, শুধু তাকিয়ে আকাশের রূপ পরিবর্তন আর সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের সাক্ষী হলাম।

কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিন বেশ কয়েকবার যাওয়া হলেও সোনাদিয়ার মতো উঁচু ঢেউ কখনও দেখা হয়নি। দেখতেই যেন এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে। একইভাবে সৈকত থেকে যখন তাঁবুর দিকে চোখ ফেরাচ্ছিলাম, প্রতিবার মনে হচ্ছিল ঝাউবনে ঘেরা কোনো এক গহিন বালুচর গভীর মায়ায় বারবার আলিঙ্গন করে নিচ্ছে।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা গড়িয়ে আঁধার নেমে এলে অমাবস্যার সঙ্গে শুরু হয় ভাটার গগনবিদারী গর্জন। এ গর্জন যেন সমুদ্রের আক্ষেপের গর্জন কিংবা তার বিশালতার অহংকারের।

আঁধারের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের গর্জন আর বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বালুর উড়ে চলা যেন মরুভূমির ধূলিঝড়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। এক মায়াবী ঘোর বারবার আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে আমাদের চিন্তার জগৎকে।

সারারাত আড্ডা জমিয়ে ঝাউগাছের নিচে হ্যামকেই ঘুমিয়ে পড়ি আমরা। পরদিন ভোরে চোখ খুলতেই সমুদ্রের আকাশচুম্বী ঢেউ চোখে পড়লে ভাবি, 'সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।' চার দিনের সোনাদিয়া ভ্রমণে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে তা হলো এখানকার গ্রাম্য পরিবেশ। ঝাউগাছ কেটে তারা ভেড়ার খামার করে, বাড়ির ভিত্তি তৈরি করে। বন বিভাগের দালান ছাড়া নেই কোনো ইটের দালানকোঠা।

সোনাদিয়ার পরিবেশ নির্জন হলেও যারা যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না, তাদের জন্য এই ট্যুরটি নয়। নেই কোনো বিলাসবহুল সুযোগ-সুবিধা, নেই ইচ্ছামতো খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা। এখানকার মানুষ সহজ-সরল, তবে চোর হতে সাবধান। 

নৈসর্গিক প্রিন্সেস আইল্যান্ডস
কিংবদন্তির দিল্লির আখড়া

আপনার মতামত লিখুন