শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঘুরে আসি

রাতারগুলে একদিন

নাকিব নিজাম
২৮ আগস্ট ২০২১

দু'পাশে করচা গাছের সারি, মাথার ওপরে শতবর্ষী অর্জুনের ডাল-পালা, চোখ যতদূর যায় গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে বন। চারদিক শান্ত, সম্পূর্ণ কোলাহলমুক্ত। মাঝে মধ্যে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কিছু অজানা পাখির ডাক। থমথমে এক পরিবেশে নৌকার বৈঠায় ওঠা পানির কলকল ধ্বনিও যেন সুমধুর মনে হয়। টলটলে জলে অর্ধেক ডুবে থাকা গাছের পর গাছ নিয়ে বিশাল বন। ডালে ডালে নানা জাতের পাখির কলতান; জলে মাছের সঙ্গে সাপ-ব্যাঙের বসবাস। সব মিলিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর জলাবন রাতারগুল 'সিলেটের সুন্দরবন' নামে পরিচিতি পেয়েছে আগেই। সারাবছর পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও বর্ষায় পানি বাড়ায় প্রকৃতিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে বেশি।

ধীরে ধীরে বনের যত গহিনে যেতে লাগল নৌকা, যত গহিনে যাওয়া যায়, ততই জলে ডুবে থাকা মহীরুহের আচ্ছাদনে হারিয়ে যাওয়া। এ যেন অদ্ভুত এক জলের রাজ্য। ঘন হয়ে আসা বৃক্ষের কারণে কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন সবুজাভ আভা দেখা যায় পুরো জলাবনে।

কোনো বৃক্ষ হাঁটু পানিতে ভেসে আছে আবার কোনো বৃক্ষ অর্ধেক জলে ডুবে গেছে। যতই এই জলেশ্বরীর গহিনে যাওয়া যাবে ততই গাছের ঘনত্ব বাড়তে থাকবে। সূর্যের আলোও অনেক জায়গায় এই বৃক্ষ ভেদ করে আসতে পারে না। বর্ষার সময় পানি এত পরিস্কার থাকে, সবুজাভ পানিতে গাছের প্রতিবিম্বকে মনে হয় বনের নিচে আরেকটি বন।

সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট অঞ্চলের প্রায় ৩ হাজার ৩২৬ একর জমি নিয়ে সিলেটের সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের আমাজন খ্যাত রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের অবস্থান। উত্তরে গোয়াইন নদী, দক্ষিণে শিমুল বিল ও নেওয়া বিল হাওরের মাঝামাঝি অবস্থানরত এ বনের নামকরণের সঙ্গে শীতলপাটি শিল্পের রয়েছে গভীর সম্পর্ক।

মুর্তাগাছ তথা পাটি গাছ, স্থানীয়ভাবে রাতা গাছের বন থেকে এখানকার নামকরণ হয়েছে রাতারগুল জলাবন তথা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট।

জুলাই থেকে অক্টোবর অর্থাৎ ভরা বর্ষায় রাতারগুল তার যৌবন ফিরে পায়। এ সময় ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। এ ছাড়া শুকনা মৌসুমে ১০ থেকে ১৫ ফুট পানির নিচে থাকে। শীত মৌসুমে এটি হয়ে ওঠে পরিযায়ী পাখিদের মিলনমেলা।

কোষা নৌকা বা ডিঙি নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে মাঝির গলায় ওঠা গানের সুর নিয়ে যাবে অন্য এক রাজ্যে। পানকৌড়ি কিংবা মাছরাঙার উড়াল দিয়ে মাছ শিকার, এক পা ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকা বকপাখিদের আনাগোনা, মেছোবাঘ-কাঠবিড়ালি-বানরদের এক ডাল থেকে অন্য ডালে বিচরণ ভুলিয়ে দেবে যান্ত্রিক কোলাহল।

প্রকৃতির এ অমায়িক রূপসুধা উপভোগ করতে বন বিভাগের বিট অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে চলে যেতে পারেন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে। এক থেকে দেড় হাজার টাকা নৌকা ভাড়ায় ঘুরে দেখা যাবে বাংলার আমাজন খ্যাত মিঠাপানির এই জলাবনকে। প্রাণিবৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য এই জলেশ্বরীতুল্য বনের জল এতটাই স্বচ্ছ, মাছের চলাফেরা খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়।

পানিপ্রধান এই অঞ্চলে দেখা মিলবে সাপ কিংবা জোঁকের। তাই সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয়। ওয়াচ টাওয়ার থেকে ফ্রেমবন্দি করে নিতে পারেন রাতারগুলের এক অপূর্ব দৃশ্য। উপভোগ করা যেতে পারে কায়াকিংয়ের অভিজ্ঞতা।

পর্যটন জায়গাগুলোর সৌন্দর্য বজায় রাখতে পর্যটকদের ভূমিকা মুখ্য। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে পানি দূষণ কিংবা পরিবেশ দূষণ করা থেকে বিরত থাকতে পারলেই রাতারগুল বাঁচবে অনেক বছর, ভিড় বাড়বে পরিযায়ী পাখিদের এবং সমৃদ্ধ হবে পর্যটন শিল্প। 

যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সিলেট সদরের উদ্দেশে অনেক বাস ছেড়ে যায়। সিলেট নগরী থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে রাতারগুলের অবস্থান; সদর উপজেলার সীমানা ঘেঁষে গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে। নিজস্ব বা ভাড়া গাড়ি ছাড়াও নগরীর আম্বরখানা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় সাহেববাজার হয়ে রাতারগুল গ্রামে যাওয়া যায়। গ্রাম থেকে পরে হেঁটে যেতে হয় জলাবনের সৌন্দর্য উপভোগে। আবার আম্বরখানা থেকে গাড়িতে মোটরঘাট গিয়ে সেখান থেকে নৌকাযোগে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। যেহেতু এখন করোনাকাল চলছে, তাই প্রশাসনের স্বাস্থ্যবিধি নির্দেশনা অবশ্যই মেনে চলে ভ্রমণ করবেন।

হারিয়ে যাওয়া এক শহর
ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্বেষণে

আপনার মতামত লিখুন