শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
গোলাম কিবরিয়ার ভ্রমণ কাহিনী

হারিয়ে যাওয়া এক শহর

গোলাম কিবরিয়া
২৮ আগস্ট ২০২১

কর্মব্যস্ত জীবনে আমাদের যেন সামান্য ফুরসত মেলে না নিজের জন্য একটু সময় বের করার। সবাই চান অল্প সময়ে স্বল্প বাজেটে কাছে কোথাও ঘুরে আসতে। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে। পরিকল্পনামাফিক 'আমার বাংলাদেশ' ট্রাভেল গ্রুপ থেকে আমরা চললাম সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর, পানাম নগর। তিব্বত বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল সোয়া ৮টায় আমরা ছয়জন মনজিল পরিবহনে চড়ে বসলাম। গন্তব্য গুলিস্তান। মনে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল। বাসে বন্ধুরা আড্ডায় মেতে উঠলাম। মনের মাঝে তখন সুর বেজে উঠছে হেমন্তের গান 'পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি/সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি।' পথ হারাতে হয়নি। আমরা ঠিক ঠিক পৌঁছে গেলাম গুলিস্তান। মেঘলা পরিবেশে উদগ্রীব মনে বাস থেকে নামলাম। অন্য বাসে চেপে এবারের গন্তব্য মোগরাপাড়া।

অল্প সময়েই আমরা পৌঁছে গেলাম মোগরাপাড়ায়। এবার কিন্তু উদরপূর্তি করার সময়। কারণ সকালের নাশতা যে এখনও করা হয়নি। পেটপূজা করে নিলাম পরোটা, ডাল-ভাজি আর মিষ্টি দিয়ে। ডাল-ভাজিটা অসাধারণ ছিল। মোগরাপাড়া বাসস্ট্যান্ডেই এমন অনেক খাবারের দোকান পাবেন। নাশতা শেষে ইজিবাইকে করে এবার পানাম নগর।পৌঁছে প্রথমেই যা মনে এলো তা হলো, আমরা যেন কল্পনার কোনো জগতে এসে পড়েছি। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর- প্রাচীন সোনারগাঁর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরোনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বারোভূঁইয়াদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। নগরী চিরে চলে যাওয়া পানাম সড়ক। আর সড়কের দু'পাশে সারি সারি আবাসিক একতলা ও দ্বিতল বাড়িতে ভরপুর পানাম নগর। ১৫ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠে পানাম নগরী। পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি রয়েছে।

পানাম নগরে ঢুকেই চোখে পড়বে একটি সরু রাস্তার ধারে সারি সারি পুরোনো দালান। কোনোটা দোতলা, কোনোটা আবার এক তলা। এ ছাড়া আছে ৪০০ বছরের পুরোনো টাঁকশাল বাড়ি। বাড়িগুলোর স্থাপত্য নিদর্শন দেখে বোঝা যায় এখানে ধনী বণিকশ্রেণির লোকেরা বসবাস করতেন। বাড়িগুলোতে মোগল ও গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ দেখা যায় এবং প্রতিটি বাড়ির কারুকাজ স্বতন্ত্র।

আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠা বাড়িগুলোতে ধুলো জমলেও আপনার মুগ্ধতা সামান্যতমও কমবে না। এরপর আমরা ঘুরে নিলাম সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর। বাংলাদেশের লোকশিল্পের সংরক্ষণ, বিকাশ ও সর্বসাধারণের মধ্যে লোকশিল্পের গৌরবময় দিক তুলে ধরার জন্য ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার বিশাল এলাকা নিয়ে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। সোনারগাঁয়ের 'বড় সর্দারবাড়ি' নামে পরিচিত একটি প্রাচীন জমিদার প্রাসাদে এই জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। এখানে আরও রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, কারুপল্লি ও একটি বিশাল লেক। জাদুঘরে দর্শনার্থীরা দেখতে পাবেন বাংলার সুলতানদের ব্যবহূত অস্ত্রশস্ত্র, তৈজসপত্র, পোশাক, বর্ম, অলংকার ইত্যাদি। বাংলার প্রাচীন ও মধ্য যুগের লোকশিল্পের অনেক নিদর্শন রয়েছে এখানে; রয়েছে বাংলার প্রাচীন মুদ্রা। কারুপল্লিতে বৈচিত্র্যময় দোচালা, চৌচালা ও উপজাতীয়দের আদলে তৈরি ঘরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অজানা, অচেনা, আর্থিকভাবে অবহেলিত অথচ দক্ষ কারুশিল্পীর তৈরি বাঁশ-বেত, কাঠ খোদাই, মাটি, জামদানি, নকশিকাঁথা, একতারা, পাট, শঙ্খ, মৃৎশিল্প ও ঝিনুকের সামগ্রী ইত্যাদি কারুপণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া প্রতি বৈশাখ মাসে এখানে সাড়ম্বরে আয়োজিত হয় লোকশিল্প মেলা। এ মেলায় লোকসংগীত, যাত্রাপালা, কবিগান ইত্যাদি লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। মেলায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসেন লোকজ ও কারুশিল্পরা। মাটি, শোলা, বাঁশ, বেত, কাপড়সহ বিভিন্ন হস্তশিল্পজাত সামগ্রী বিক্রি হয় এ মেলায়। এ ছাড়া জাদুঘরের সামনে অবস্থিত লেকে নৌকাভ্রমণ ও শীত মৌসুমে টিকিট কেটে মাছ ধরার ব্যবস্থা আছে। দর্শনার্থীদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য রয়েছে ক্যান্টিন। এভাবেই একটি দিন স্বল্প সময়ে পরিবার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের ধারক এই নগরী ও জাদুঘর থেকে।

কিংবদন্তির দিল্লির আখড়া
রাতারগুলে একদিন

আপনার মতামত লিখুন