শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঘুরে আসি

হাওরের হাতছানি

গোলাম কিবরিয়া
০৩ নভেম্বর ২০২১

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন বৈচিত্র্যময় ঋতুর সমাবেশ সম্ভবত আর নেই। আর তাই তো কবি বলেছেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। পাহাড়, নদী, বন, জঙ্গল, ঝরনাধারা, ফল, ফসল এবং পাখিদের কলকাকলিতে চির রূপ মাধুর্যে 'দুগ্ধ স্রোতরূপী' বাংলাদেশ। এর প্রতি পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাহাড়, নদী ও হাওরের নির্মল উজ্জ্বলতা। হাওরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জলরাশি এক অপরূপ মহিমায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

দ্বীপের মতো করে গড়ে ওঠা ঘরবাড়িগুলো বর্ষাকালে যেমন চোখজুড়ানো দৃশ্যপট তৈরি করে, তেমনি শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হাওরাঞ্চলে পাখ-পাখালিদের কলতান কিংবা শুস্ক মৌসুমের পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদের ছড়াছড়ি হাওরকে মন জুড়ানো রূপ দেয়। গত কয়েক বছরে হাওর পর্যটনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর মাধ্যমে হাওর এলাকায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো। ফলে আর্থসামাজিক উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে হাওর এলাকায়। তাছাড়া হাওর এলাকায় বর্তমানে যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, তা পর্যটন বিকাশে সহায়ক।

বিশেষত মিঠামইন হাওর এলাকায় প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট নির্মাণ এবং রূপালি জ্যোৎস্নায় টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় ভেসে বেড়ানোর মতো আকর্ষণ থাকায় দেশীয় পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে। দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকের পছন্দের তালিকায় বর্তমানে এ গ্রামীণ পরিবেশ। এর কারণ হিসেবে গ্রামে কৃষকদের ধান কাটার দৃশ্য, সংস্কৃতি, গ্রামবাংলার মেঠো পথ, সবুজ প্রকৃতি, গ্রাম্য পশুপাখি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে গ্রামীণ পরিবেশসহ আরও অসংখ্য প্রাকৃতিক আকর্ষণের উন্নয়ন বাংলাদেশের আগামী পর্যটনের উন্নয়নে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাত জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে সর্বোচ্চ ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে চারটি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনটি হাওর রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এ হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল অঞ্চলে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বর্ষাকালে হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজ প্রাণী আর হাওরপাড়ের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে পর্যটকদের মনে। শীতের মৌসুমে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পাখির মিলনমেলা ও সবুজের সমারোহ চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যে প্রাণ ছুঁয়ে যায় পর্যটকদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সন্তোষ কুমার দেব হাওর পর্যটনের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেন, 'হাওর পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর অনেক ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। মানুষের কাছে দেশের হাওরের অপার সৌন্দর্যের কথা তুলে ধরতে হবে। দেশের বিভিন্ন জেলার হাওর নিয়ে আলাদা প্রমো যদি আমরা করতে পারি আর তা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে এ দেশের মানুষ হাওরের সৌন্দর্য উপভোগে আরও আকৃষ্ট হবে। তখন দেশের বাইরে ভ্রমণের চাইতে দেশেই ভ্রমণ করতে মানুষ বেশি আকৃষ্ট হবে। এর ফলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা হাওরে ঘুরতে যান তাদের জন্য ভালো থাকার ব্যবস্থা নেই। ভালো থাকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি হাওরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন প্রয়োজন। হাওরে ভাসমান খাবারের দোকান থাকলে পর্যটকদের জন্য অনেক সুবিধা হতো। এতে স্থানীয় মানুষের জীবনমান ও অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো হতো। সবমিলিয়ে হাওর পর্যটনের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে শুধু পর্যটনের প্রসার হবে তাই নয়, একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ভূমিকা রাখবে।'

সিলেট ও মৌলভীবাজারের পাঁচটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওর প্রায় ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত। হাকালুকি হাওরে শীতকালে অতিথি পাখির আগমন ও স্থানীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলতানে মুখর পরিবেশ ভ্রমণপিয়াসুদের আহ্বানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০০০ সালে রামসার সাইটের তালিকায় স্থান করে নেওয়া সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি ঝরনা ভারতের মেঘালয় থেকে এসে মিশেছে, সেই সঙ্গে হাওরজুড়ে ৪৬টির মতো দ্বীপ-সদৃশ ছোট ছোট গ্রাম নয়নাভিরাম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। ১২০টি বিল ও ১৮০টি নিম্নাঞ্চল মিলে তৈরি টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বচ্ছ পানির সঙ্গে ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপ এবং শীতকালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির বিচরণ এক অকল্পনীয় জীববৈচিত্র্য গড়ে তুলেছে।

হাওর পর্যটন নিয়ে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) প্রেসিডেন্ট মো. রাফেউজ্জামান বলেন, 'হাওর পর্যটনের অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য ও বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর বসবাসের ফলে পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে হাওর। আমাদের দেশের মানুষ হাওর খুব উপভোগ করে। আমরা দেশের বাইরের পর্যটকদের আকৃষ্ট করতেও সচেষ্ট রয়েছি। ট্যুরিজম বোর্ড ও টোয়াব হাওর পর্যটন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। টাঙ্গুয়ার ও নিকলী হাওর শুধু নয়, বিভিন্ন জেলার হাওরের পর্যটন উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।'

সুনামগঞ্জ জেলার হাওরগুলোর আছে মনোমুগ্ধকর নাম যেমন- টাগুয়ার হাওর, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, দেখার হাওর, হালির হাওর, কড়চা হাওর, পাকনা হাওর, ধলা পাকনা হাওর, আঙ্গরখালি হাওর, খচ্চর হাওর, নখলা হাওর, সানুয়াডাকুয়া হাওর, শৈল চকরা হাওর, হৈশাম হাওর, বড় হাওর, হালিয়ার হাওর, চন্দ্রসোনার থাল হাওর, ডিঙ্গাপুতা হাওর প্রভৃতি।

টাগুয়ার হাওরসহ আশপাশের পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের মানসম্মত খাওয়া-দাওয়া ও বাসস্থানের সুযোগ না থাকায় বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটক আকর্ষণ করা যাচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে হোটেল-মোটেল স্থাপন করা যেতে পারে। এ ছাড়া ট্যুরিস্ট গাইড তৈরি করা যেতে পারে। ইকো ট্যুরিজমও হতে পারে হাওরাঞ্চলের বিকল্প কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত।

ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার। এ জেলা হাওর-বাঁওড়ের জেলা নামে অধিক পরিচিত। এখানেও হাওর ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা; যা স্থানীয় জীবনমান উন্নয়নেও প্রভাব রাখছে।

পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, হাওর এলাকায় পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে সবচেয়ে যেটি বেশি প্রয়োজন, তা হলো জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি করে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা তুলে ধরা। পর্যটকদের স্বাভাবিক যোগাযোগ সুবিধা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করা; হাওরের পর্যটন তুলে ধরতে বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক মাধ্যম ব্যবহার; পর্যটনসেবা প্রদানকারী সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা; হাওর জেলাগুলোয় স্যানিটেশনের সব সুবিধা নিশ্চিত করা এবং সেই সঙ্গে পর্যটন টাওয়ার স্থাপন করে পর্যটকদের সেবার ব্যবস্থা করা এবং সর্বোপরি হাওরাঞ্চলে পর্যটন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করা এখন সময়ের দাবি।

অসীম সম্ভাবনা বুকে ধারণ করে জেগে আছে হাওর। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান হাওরের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। যদি হাওরের এ অপার সম্ভাবনা ও সুযোগকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়, তাহলে একদিকে যেমন হাওরবাসী উপকৃত হবে, তেমনি দেশ অর্থনীতিতে আরও সমৃদ্ধিশালী ও অগ্রসরমান হবে। হাওরই হতে পারে আরেক অর্থনৈতিক অঞ্চলের উপযুক্ত পরিবেশ।

৬ প্রতিবন্ধীর জীবন বদলে দিলেন ওয়ালটনের এমডি
সৈয়দপুর-কক্সবাজার রুটে ফ্লাইটসংখ্যা বাড়াল বিমান

আপনার মতামত লিখুন