শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
দেখা থেকে লেখা

সাগরকন্যা কুয়াকাটায়

আশিকুর রহমান
২৮ মার্চ ২০২২

দিনটি ছিল বুধবার। ২ মার্চ, ২০২২। সকাল থেকেই উত্তেজনা আর হৃদয়ের কম্পন যেন থামছেই না।

সাগরকন্যাখ্যত কুয়াকাটায় যাবো। দীর্ঘসময় করোনাভাইরাস মহামারীর স্তব্ধতা ভেঙ্গে যেন এক পশলা বৃষ্টি নামল সব ভ্রমণপিপাসুর হৃদয়ে।

আমরা ছিলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপের পুরো ইউনিট। ভ্রমণের দুদিন আগেই আজাদ ভাই (ইউনিট কাউন্সিল সভাপতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ) জানান, দুপুর ৩টায় ক্যাম্পাস থেকে যাত্রা করবো। কিন্তু পরে জানতে পারলাম কোন সমস্যার কারণে যাত্রা শুরু হবে রাতে।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গেলাম রোভার ডেনে। একি অবস্থা সবার! সবাই উচ্ছ্বসিত আর খুশির জোয়ারে বইছে রোভার ডেনে। এদিকে অপেক্ষমান মন ছুটছে যেন সমুদ্রের পানে। বাস ছাড়ার আগ মুহূর্তেই যেন সেলফি তোলার মহড়া শুরু হয়েছিলো সবার। অবশেষে সব প্রস্তুতি শেষ করে রওনা দিলাম রাত ৮টায়।

বাসে উঠেই যেন মনে হলো বাসের গতির সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব কমছে বহুল প্রতীক্ষার সেই সাগরকন্যার। মাগুরা পৌঁছলাম রাত ১০টায়। সেখানে রাতের খাবার খেলাম। খাবার শেষে তো ওয়ালিউল্লাহ ভাইকে (সিনিয়র রোভারমেট) তার নিজ জেলা নিয়ে সবাই ইচ্ছামতো পঁচানিও দিল। আবার রওনা দিলাম কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। একটু পরই স্কাউট প্রার্থনা সঙ্গীত দিয়ে আজাদ ভাই শুরু করল আমাদের চলন্ত বাসের সাংস্কৃতিক পর্ব।

শিক্ষা সফরের লটারি বিক্রির কাজ পেলাম। সবার কাছে লটারি বিক্রি করলেও সালেহ স্যার (সম্পাদক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ) ও মিরা আপু (সিনিয়র রোভারমেট) যেন পাত্তাই দিল না আমার মতো হকারকে। তবে বেশি ভালো লেগেছে হকার সেজে সবার কাছে লটারি বিক্রি করা। মধ্যরাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন তখন মুসা ভাই (ইউনিট কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ) ও আমি চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করায় ব্যস্ত।

পরদিন বৃহস্পতিবার। ভোর ৪টায় পৌঁছলাম কুয়াকাটায়। বাস থেকে নামতেই দেখি সবার উৎসুক নয়নজোড়া যেন সকালের সূর্যোদয় ও বেলা শেষে সূর্যাস্তের মোহে ছলছল করছে। সবাই হোটেলে উঠলাম। ফ্রেশ হতে হতেই চলে এলো আমাদের বহনকারী কয়েকটি ভাড়া বাইক। রওনা করলাম সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্যে। সমুদ্রের তীর ঘেষে, বালির উপর দিয়ে বাইক রাইডিং ছিল যেমন ভয়ংকর ঠিক ততটাই রোমাঞ্চকর। মোতালেব একসময় তো বলেই দিল, আমার ভয় করছে। ওকে সাহস দিলাম।

সমুদ্র তীর ঘেষা ঝাউবন, ছোট বাঁধ ও রাশি রাশি বালি পেরিয়ে পৌঁছলাম গঙ্গামতির চরে।

কেউ অপেক্ষা করছে সূয্যিমামার, কেউবা আবার সমুদ্রের স্মৃতি রাখতে ছবি তোলায় ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পরই দেখা মিলল সবার আগ্রহের সূর্যের। যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে এক লাল রক্তিমার আবির্ভাব। অপরূপ সূর্যরশ্মি যেন ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে পড়ছে সবার শরীরের উপর। বিভিন্ন জেলা থেকে ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপর যাত্রা রাখাইন পল্লি, বৌদ্ধনাথ মন্দির ও কুয়াকাটা ঐতিহাসিক কুয়ার উদ্দেশ্যে। সেখানে রাখাইনদের জীবনব্যবস্থা ও তাদের কথা বলার ভাষার ভিন্নতা এই প্রথম দেখেছিলাম। দেখতে দেখতে নাস্তা করার সময় হলো। চলে এলাম হোটেলে।

তখন দুপুর, কড়া রোদ। সমুদ্রে এসেছি, কিন্তু এত জলরাশি আর ঢেউয়ের মাঝে গোসল না করলে যেন ভ্রমণই বৃথা। তীরে গিয়ে আমরা স্কাউট মোটোর বাস্তব রূপ দিতে সমুদ্র তীর পরিচ্ছন্ন সেবা দেই। তারপর শুরু ফুটবল খেলা। কড়া রোদেও যেন সুবাসিত বাতাস মনকে প্রফুল্ল করছিল। নেচে উঠেছিলাম যখন আমার দল বিজয়ী হয়।

তারপর সবাই পর পর সমুদ্রে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে গোসলের উদ্দেশ্যে। আমিও দিলাম। সমুদ্রে ঢেউ এসে খেলা করতে লাগল শরীরে। কিছুক্ষণ পরপরই জেলিফিস ভেসে উঠতে লাগলো। লবণাক্ত স্বাদও পেলাম। বেশি উচ্ছ্বাসে তো রুহুল ঢেউয়ের প্রকোপে তার চশমাই হারিয়ে ফেলে। বিকেলের দৃশ্যে সমুদ্রের তীর ঘেষে লাল কাঁকড়া ও ঝিনুকের ছড়াছড়ি। কেউ লাল কাঁকড়া ধরছে, আবার মিরা আপু, শ্যামলী আপু, ইতি ও রত্না ঝিনুক কুড়োনোয় ব্যস্ত। আজাদ ভাই, ওয়ালিউল্লাহ ভাই ও স্যারসহ তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্র উপভোগ করছে। লাল কাঁকড়া অভয়ারণ্য, লেবুবন, শুটকির চরসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলো যেন এক একটা পার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার আদর্শ জায়গা।

কিছুক্ষণ পর সূর্য অস্ত যাবার পালা। অধীর অপেক্ষায় পর্যটকরা। সূর্য যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে। সূর্যের রক্তিম আভায় যেন সমুদ্রের বিশাল জলরাশি রক্তাক্ত। এই সূর্যাস্ত ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

ফেরার পথে সারি সারি সামুদ্রিক মাছ ও কাঁকড়ার দোকান। কুয়াকাটায় এসেছি, কাঁকড়া খাব না তা কি করে হয়! কেউ টুনা মাছ, কেউ কাঁকড়া ফ্রাই খেলো। দুটোর স্বাদ যেন এখনও লেগে আছে সবার মুখে মুখে। রাত ৮টা। কেনাকাটায় ব্যস্ত সবাই। কেউ আচার, কেউ উপহার সামগ্রী। তুহিন তো হেড মাসাজার কিনে বেজায় খুশি। আমি, রুহুল ও মোতালেব গেলাম সমু্দ্রে। চারপাশের নিস্তব্ধতার মাঝে রাতের সমুদ্রের গর্জনে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।

পরদিন শুক্রবার।  সকালে নাস্তা করে রওনা দিলাম ষাট গম্বুজ মসজিদের উদ্দেশ্যে। ফেরার সময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, খান জাহান আলির মাজার, বাগেরহাট জাদুঘর ও ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন করলাম। নাম ষাট গম্বুজ হলেও এই মসজিদের গম্বুজ সংখ্যা ৭৭। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। নান্দনিক ও ঐতিহাসিক স্থানে গিয়ে সেই পনেরশ শতাব্দীর খান জাহান আলির সময়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। দর্শনার্থীরা কেউ ছবি তুলছে, কেউবা নামাজ আদায় করছে। তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সারি সারি পলাশ ফুলের দৃশ্যে মন আটকে গেছে।

সারাদিনের ভ্রমণ শেষ করে যাত্রা করলাম ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। তখন মনে পড়ছিল হেমন্ত মুখার্জীর সেই গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। সমুদ্র পানে মন ছুটছিল বারবার, কিন্তু কী আর করার! আবার ফেরার সুযোগ হলে রাতের স্তব্ধতা ও ঢেউয়ের গর্জনের কাছে গিয়ে শোনাবো আমার সব পূর্ণতা-অপূর্ণতার গল্প।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

পর্দা উঠছে টোয়াবের পর্যটন মেলা
পবিত্র রমজানে ওমরাহ যাত্রী বাড়ছে তিনগুণ

আপনার মতামত লিখুন