শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫ | ১২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ইভেন্ট

সুন্দরবন নাশ করে মনোরঞ্জনের আয়োজন

হাসান হিমালয়, খুলনা
২১ মার্চ ২০২২

সুন্দরবন প্রকৃতির অনবদ্য দান। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূল বনটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় সুরক্ষাবলয় হিসেবে সিডর, আইলা, বুলবুল কিংবা আম্পানে ঢাল হিসেবে রক্ষা করেছে আমাদের। অথচ ভালোবাসার এ বন খোদ বন বিভাগের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও লোভের শিকার। 'উন্নয়নের' নামে গাছপালা কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে ইট-কংক্রিটের ইকো ট্যুরিজম পার্ক।

২০১৭ সালে সুন্দরবনে চারটি টহল ফাঁড়ি নির্মাণের প্রস্তাব দেয় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বন বিভাগ বলেছিল, এখানে ফাঁড়ি স্থাপন করলে বিপুলসংখ্যক গাছপালা কাটতে হবে, যা জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বন বিভাগের এ অকাট্য যুক্তির কারণে র‌্যাবের সেই প্রস্তাব অনুমোদন পায়নি। সাড়ে চার বছর পরে সেই বন বিভাগই বনের গাছ কেটে পর্যটন কেন্দ্র করছে। ইকো ট্যুরিজমের নামে হচ্ছে কংক্রিটের স্থাপনা। এতে বনে পর্যটক ও নৌযানের চাপ বাড়বে। স্থায়ী স্থাপনাগুলো দীর্ঘমেয়াদে বন্যপ্রাণী ও বনের প্রতিবেশ-পরিবেশের ক্ষতির কারণ হবে। তাই এ পরিকল্পনা থেকে সরে আসার পরামর্শ বন-সংশ্নিষ্টদের।

সুন্দরবনের ভেতরে করমজল, কটকা, কচিখালী, দুবলারচর, কলাগাছিয়া, হাড়বাড়িয়া ও নীলকমল নামে সাতটি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো সংস্কারের পাশাপাশি আরও চারটি নতুন পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা হয় ২০২০ সালে। 'সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটন (ইকো ট্যুরিজম) সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন' নামের প্রকল্পটি অনুমোদন পায় সে বছরের ২৮ জুন। ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের আগস্ট থেকে।

প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের কালাবগী (কৈলাসগঞ্জ) ও শেখের টেক এবং চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক ও শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্দায় ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। হাড়বাড়িয়া, কটকা ও কচিখালীতে সাতটি আরসিসি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হবে। বনের মধ্যে পর্যটকদের হাঁটার জন্য দুই মিটার প্রশস্ত ও তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পথ, তিন কিলোমিটার আরসিসি রাস্তা, আটটি পাবলিক টয়লেট, ৩০টি বেঞ্চ ও ২০টি ডাস্টবিন নির্মাণ হবে। এর সবই কংক্রিটের। এ ছাড়া করমজলে একটি ঝুলন্ত ব্রিজ, ১৬টি গোলঘর, করমজল ও কলাগাছিয়ায় দুটি গেট এবং পর্যটকদের ঘোরার জন্য নৌকা কেনা হবে। পর্যটন কেন্দ্রে কংক্রিটের খাঁচার মধ্যে হরিণ ও কুমির রাখা হবে।

দাকোপের কালাবগী ইকো ট্যুরিজম ঘুরে দেখা গেছে, খালের ওপারে বনের একটি অংশ গাছ কেটে ফাঁকা করে পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে। আরসিসি হাঁটাপথ, হরিণ ও কুমিরের শেড, টাওয়ারের কাজও চলছে সমানতালে। বাথরুম ও গোলঘরের কাজ প্রায় শেষ। হরিণসহ কয়েকটি শাবক ও দুটি কুমির আটকে রাখা হয়েছে। শেডের কাজ শেষ হলে এগুলো ছাড়া হবে। শেখের টেকে হাঁটাপথ হচ্ছে মন্দির ঘিরে। সেখানেও অনেক গাছ কাটা পড়ছে। একইভাবে কাজ এগিয়ে চলেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আন্ধারমানিক ও আলীবান্দায়।

গাছ কাটা নিয়ে খুলনা রেঞ্জ কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক এজেডএম হাছানুর রহমান বলেন, কালাবগীর জায়গা ফাঁকাই ছিল। হাঁটাপথের জন্য সেখানে অল্প কিছু গাছ কাটা পড়েছে। শেখের টেকে গরান গাছ বেশি। এগুলো বর্ধনশীল নয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়। কাটলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বিশেষজ্ঞ মত: সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি বলেন, ইকো ট্যুরিজমের নামে যা করা হয়, তা শেষ পর্যন্ত পরিবেশসম্মত থাকে না। এসব জানার পরও এমন সংবেদনশীল জায়গায় কী ধরনের আচরণ করা উচিত, অনেকেই বোঝে না। এটা বনের জন্য ক্ষতিকর। তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের মতো বনে উন্মুক্ত পর্যটনের সুযোগ কম রাখা দরকার। মানুষ যে পারফিউম, কসমেটিকস ব্যবহার করে, এর ঘ্রাণ প্রাণীরা অপছন্দ করে, যা তাদের প্রজননকেও বাধাগ্রস্ত করে।

বনের মধ্যে কংক্রিটের স্থাপনা বন ও বন্যপ্রাণীর জন্য ক্ষতিকর মন্তব্য করে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, পর্যটন ব্যবসায়ীদের খুশি করতে বন বিভাগ যা করছে, তাতে বনেরই ক্ষতি। এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম ডেভিড বলেন, পর্যটকরা সুন্দরবনে ইট-পাথরের স্থাপনা নয়, প্রকৃতি দেখতে যান। বনের মাটি ও কাঠের হাঁটার রাস্তাই তাদের বেশি টানে। নতুন স্থাপনা তাদের বিরক্তির কারণ হবে। তিনি বলেন, 'সুন্দরবন রক্ষার বড় অংশীজন হলেও এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আমাদের পরামর্শ নেওয়া হয় না। ফলে বনে চিড়িয়াখানার মতো হাস্যকর স্থাপনা হচ্ছে। সুন্দরবনে মানুষ খাঁচার মধ্যে থাকা হরিণ-কুমির দেখতে যাবে কেন?'

বন বিভাগের ভাষ্য: প্রকল্প পরিচালক ও খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, প্রতি বছরই পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। এতে বনে চাপ বাড়ছে। এ চাপ কমাতে লোকালয়ের কাছাকাছি এলাকায় চারটি কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। স্থাপনা টেকসই করতে আরসিসি করা হচ্ছে। কাঠ দিয়ে তৈরি করলে গাছ কাটতে হতো। সেটিও তো বনের জন্য ক্ষতিকর।

২০২২-কে ‘ইফিশিয়েন্ট ইয়ার’ ঘোষণা করলেন ওয়ালটনের সিইও গোলাম মুর্শেদ
ভারত ভ্রমণেচ্ছুকদের জন্য সুখবর

আপনার মতামত লিখুন