শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

সুন্দরবনে পর্যটন 'সম্ভাবনা'

পরিবেশ-প্রতিবেশ থাকুক অগ্রাধিকারে

সম্পাদকীয়
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটক টানতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের যে উদ্যোগের কথা শনিবার সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সেটাকে আমরা সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানাতে চাই। স্বাগত এই কারণে যে, সুন্দরবনের পর্যটন সম্ভাবনা বহুলাংশে অনুন্মোচিত রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাড়লেও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে এই ম্যানগ্রোভ এখনও প্রথম সারির গন্তব্য হয়ে উঠতে পারেনি। বস্তুত সমকালের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে- বনটিতে বছরে গড়ে যে দুই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন, তাদের মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা নগণ্য। প্রতিবেদনটির এই ভাষ্যও যথার্থ যে, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের ম্যানগ্রোভ বন আমাদের তুলনায় সামান্য হলেও, তা পর্যটনস্থল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বেশি পরিচিত ও পছন্দনীয়। বিদেশি পর্যটক বাড়লে সরকারের রাজস্ব আয় যেমন বাড়বে, তেমনই তৈরি হবে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। এ ক্ষেত্রেই সতর্কতা জরুরি বলে আমরা মনে করি। কারণ পর্যটক ও তাদের সহায়ক কর্মসংস্থান বাড়াতে গিয়ে খোদ সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রকৃতি যেন ক্ষুণ্ণ না হয়। খোদ সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত করে পর্যটন বাড়াতে গেলে আম ও ছালা দুটোই হারানোর আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না।

স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশ সরকার প্রাকৃতিক এই সম্পদ সুরক্ষায় যথেষ্ট তৎপর ও আন্তরিক। আমরা জানি, খোদ সরকারই ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' বা ইসিএ ঘোষণা করেছিল। বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ইসিএ ঘোষিত এলাকায় যে কোনো ধরনের কারখানা নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের মনে আছে, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা সুরক্ষায় ২০১৭ সালের আগস্টেই উচ্চ আদালত সেখানে নতুন কোনো শিল্পকারখানা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা এবং বিদ্যমান স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নানা গড়িমসির পর আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালের এপ্রিলে সুন্দরবনের ইসিএ এলাকায় বিদ্যমান স্থাপনার তালিকা উপস্থাপন করেছিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এতে দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবনের আশপাশে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ১৯০টি শিল্পকারখানা রয়েছে, যেগুলো রীতিমতো 'অনুমোদিত'। তার মধ্যে ২৪টিই ছিল 'লাল' শ্রেণিভুক্ত বা ব্যাপক হুমকিমূলক। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।

আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি, সুন্দরবনের স্বাস্থ্য রক্ষা সবচেয়ে জরুরি। নির্বিচার পর্যটন সুন্দরবনের স্বাস্থ্য ও মর্যাদাহানির অন্যতম প্রধান কারণ। এখন পর্যটন বৃদ্ধির 'মহাপরিকল্পনা' সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বনটির জন্য মহাদুর্যোগ বয়ে আনবে না তো? অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ছাড়াও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল, বনদস্যুদের গাছ ও প্রাণী শিকার এর স্বাভাবিক প্রতিবেশ বিনষ্ট করে চলেছে। সুন্দরবন এলাকায় নানা স্থাপনাও যে বনটির জন্য বৃহত্তর ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করছে- পরিবেশবাদীরা সেই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন। কয়েক বছর আগে সমকালেই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে 'মানবসৃষ্ট' দিক ছাড়াও সুন্দরবনের আয়তন হ্রাসের মতো 'প্রাকৃতিক' আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। সুন্দরবন নিয়ে বারংবার যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোও উদ্বেগ উচ্চারণ করে আসছে, তা অমূলক হতে পারে না। বনটির প্রতিবেশ ব্যবস্থা যে ক্রমেই ঝুঁকির মুখে পড়ছে- বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যা ও ঘনত্ব ক্রমেই কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট।

মনে রাখতে হবে, বিশ্বের বৃহত্তম এই প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভের সঙ্গে আর্থিক বা পর্যটন খাত ছাড়াও বাংলাদেশের ভৌগোলিক, প্রতিবেশগত এমনকি সাংস্কৃতিক তাৎপর্য গভীরভাবে জড়িত। এই বন যেমন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগে আমাদের প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে; তেমনই এর বনজ সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে বিপুল ভূমিকা রেখে চলেছে। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে এই বনের স্বাতন্ত্র্যও বিশ্বে বাংলাদেশকে দিয়েছে আলাদা পরিচিতি। বিবিধ গুরুত্ব, তাৎপর্য ও স্বাতন্ত্র্যই কিন্তু সুন্দরবনকে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব-ঐতিহ্যস্থল ও রামসার সাইটের মর্যাদা দিয়েছে- ভুলে গেলে চলবে না। যদি খোদ সুন্দরবনই না থাকে, তাহলে তো সকলই গরল ভেল! ফলে পর্যটনশিল্পের বিকাশে নজর দিতে গিয়ে বনটির অন্যান্য অবদান ভুলে যাওয়া হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল।

সম্পাদকীয়, সমকাল (২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)

পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে সৌদি আরব
কক্সবাজারকে বিশ্বমানের পর্যটন শহর গড়ে তোলা হবে

আপনার মতামত লিখুন